ইতিহাসের অলিগলিতে কিভাবে কত মোড় ঘুরে আজকে বাঙালি-সংস্কৃতি, বুঝতে সাহায্য করলেন- জুলফিকার জিন্না
- Avijit Mitra
- May 30, 2021
- 8 min read
Updated: Jun 3, 2021
বাঙলা, বাঙালি, বাঙালিয়ানা
রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রমবিকাশ

জুলফিকার জিন্না
(১)
‘ওরে বিহঙ্গ ওরে বিহঙ্গ মোর
এখনি অন্ধ বন্ধ করো না পাখা’
পৃথিবীর মানচিত্রে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বয়স খুব বেশি নয়। বাংলা ভাষারই উদ্ভব হয়েছে মাত্র বারো’শ বছর
আগে। এই বারো’শ বছরের মধ্যে ভাষাভিত্তিক একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে বাঙালিরা শিল্পে-সাহিত্যে-
উৎসবে-পার্বণে-যাপনে-সংস্কৃতিতে যে নিজস্বতাকে সুচিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছে সেটাকেই আমরা
‘বাঙালিয়ানা’ বলি। জ্ঞানতত্ত্বের সমৃদ্ধিতে দর্শনে-বিজ্ঞানে-ধর্মে-সমাজসংগঠণে যে স্বাতন্ত্র্য চিহ্নিত
হয়েছে সেটাকেই সমগ্রভাবে বাঙালির ‘রাজনৈতিক চেতনা’ বলা যেতে পারে। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল
বলেছিলেন, ‘মানুষ সমাজবদ্ধ জীব এবং রাজনৈতিক জীব’। আসলে মানুষের সমাজবদ্ধতা কিছু সামাজিক অনুশাসন
মেনে চলে, এই অনুশাসনগুলিই সংশ্লিষ্ট সমাজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞান, বস্তুত সেই কারণেই সমাজবদ্ধ
মানুষমাত্রেই রাজনৈতিক প্রজাতি। সমাজে প্রাধান্যবিস্তারকারী রাজনৈতিক চেতনা মানবসভ্যতার বিকাশ এর
সাথে সাথে শাসকের চিন্তাধারার মধ্যে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে এবং অনুশীলিত হয়েছে। পৃথিবীর রাজনৈতিক
ইতিহাসে দেখা গেছে একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সমাজশাসনের নিয়মগুলিকে শাসকেরা তাদের ধর্ম ও দর্শনচিন্তা
দিয়ে সিদ্ধ করেছেন। শাসকের ইতিহাস প্রকৃত অর্থে বাহুবল ও বুদ্ধিবলের ইতিহাস। শাসকের শক্তিসামর্থ্যের
থাকে দ্বিবিধ হাতিয়ার, এক-হননক্রীয়ার হাতিয়ার (মিলিট্যান্ট ওয়েপেন্স), দুই- ভাবাদর্শগত হাতিয়ার
(আইডিওলজিক্যাল ওয়েপেন্স)। এই দুটি হাতিয়ার পরস্পরের পরিপূরক। একটি সর্বাধুনিক রাষ্ট্রের দিকে
তাকালেও আমরা দেখতে পাই সেনাবাহিনীর বন্দুকের নল জাতীয়তাবাদী ভাবাদর্শ দিয়ে সিদ্ধ করা থাকে। এই
বাংলার রাজনৈতিক চেতনার বিবর্তনরেখাটিও বিভিন্ন কালপর্বের শাসকের বাহুবল তথা হননক্রীয়ার হাতিয়ার
এবং বুদ্ধিবল তথা ভাবাদর্শের হাতিয়ার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে এরই পাশাপাশি এই বৃহত্তর
বঙ্গভূমিতে অন্ত্যজ এবং প্রান্তিক জনমানসের লৌকিক অনুভূতি রাজনৈতিক চেতনার নির্ধারক হিসেবে থেকে
গেছে। লোকায়ত বাঙালির মানবিক দর্শনই তার রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তি। বস্তুত সেই কারণেই শাসকের
ভাবাদর্শ রণাঙ্গণে প্রামাণ্য হলেও জনমানসের ভাবাদর্শ অচিন পাখির ডানার ছন্দেই মুক্তির বার্তা লিখেছে।

ছবি : অনুস্কা দত্ত
সুপ্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি শাসকের মতাদর্শকে শাসিতের মতাদর্শে রূপান্তরের প্রক্রিয়াই সক্রিয়
থেকেছে। এই বাংলাতে নানা শাসকের বিজয়-পরাজয়ের উত্থান-পতনের কুহেলিকায় সাধারণ প্রজার জীবন
নিয়ন্ত্রিত হয়েছে, তবু কোথাও যেন অন্তস্থিত লৌকিক চেতনার চিরন্তন উপাদান হিসেবে মানব-
কল্যাণকামিতাই অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত সজীব থেকেছে। বাঙালি সংস্কৃতির এটাই হচ্ছে অনন্য বৈশিষ্ট্য।
আসলে হাজার হাজার বছর ধরে নানা নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় গোষ্ঠীর পারস্পরিক প্রভাব এবং সমন্বয়ের
ফলে গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সংস্কৃতি। এই বাংলায় সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কলঙ্কময় ইতিহাস যেমন আছে, ঠিক
তেমনি উদার মানবিক ভাব-আন্দোলনের ইতিহাসও আছে। একটু সতর্ক দৃষ্টিতে লক্ষ করলে এটা বোঝা যাবে
যে, শরিয়তি মুসলমান এবং সনাতনী হিন্দুর যাবতীয় উপাচার এই বৃহত্তর বঙ্গভূমে (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ ও
বাংলাদেশ) বাইরে থেকে আরোপিত। হিন্দুধর্মের যাবতীয় গ্রন্থের মৌলিক শিকড় যেমন রয়েছে বৃহত্তর বঙ্গের
বাইরে, ঠিক তেমনি মুসলমান ধর্মেরও প্রধান গ্রন্থগুলির( কোরাণ,হাদিস) শিকড় রয়েছে এই ভূগোলের
বাইরে। সনাতনী হিন্দু ও শরিয়তি মুসলমানের ধর্মীয় সংস্কৃতির অভ্যাস এই বঙ্গে কিভাবে আরোপিত হলো
তার তথ্যপ্রমাণ ইতিহাসে রয়েছে। এই বৃহত্তর ভূখন্ডে দুই প্রতিপক্ষীয় ধর্মীয় শাসকদের জয়-পরাজয়ের
ইতিহাসের অবিমিশ্র রসায়নেই তথাকথিত "বাঙালি সংস্কৃতি"র উদ্ভব। আমরা জানি,কিভাবে ইতিহাসের পথ
বেয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিজেতা, যেমন - মৌর্য(বৌদ্ধ), গুপ্ত(ব্রাহ্মণ্য), পাল(বৌদ্ধ), সেন(ব্রাহ্মণ্য),
তুর্কি(মুসলিম), আফগান(মুসলিম), মুঘল(মুসলিম) একের পর এক এখানে এসে একে অপরকে হটিয়ে স্বীয়

ছবি : গুগল
বংশবিস্তারেই বহুবিধ জাতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে। মূলত বহিরাগত আর্য সংস্কৃতি ও ইসলামিক সংস্কৃতির ক্রম-
আরোপন এই অঞ্চলের বিশেষ কৃষ্টির বৈশিষ্ট্য নির্মাণে সাহায্য করেছে। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই দুই
সংস্কৃতিই বাইরে থেকে আগত৷ এই অঞ্চলে যারা মূলগতভাবে বাস করত তারা ছিল সেই অনাবিল,অকৃত্রিম
ভূমিজ,অস্ট্রিক-দ্রাবিড়েরা। সাংস্কৃতিক রসায়নে এই অনার্য জাতির ভূমিকা অবিসংবাদী৷ এরা না থাকলে
ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ও আগত মুসলিমদের সাংস্কৃতিক রসায়ন সম্ভব ছিল না। আসলে বাঙালি সংস্কৃতির ভূগর্ভস্থ
রসের উৎসার বিস্তৃত অনার্যক্ষেত্র থেকে উঠে এসেছিল। প্রকৃত অর্থে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে এই
ভূখন্ডে হাজার হাজার বছরের পুরানো সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়,
যে খাদ্যাভ্যাসের কারণে বাঙালিদের বলা হয় ‘ভেতো’ বাঙালি, সেই খাদ্যাভ্যাস কিন্তু আর্য-সংস্কৃতি থেকে
আসে নি। আর্য অথবা মুসলমানরা এ দেশে ধান আনেন নি, ধানের চাষ এ অঞ্চলে আরম্ভ হয়েছিল অন্তত পাঁচ
হাজার বছর আগে। পরে কখনো আর্য, কখনো সেন, কখনো তুর্কি, কখনো আফগান, কখনো মোগল এবং
সবশেষে ইংরেজরা বঙ্গভূমি দখল করেছেন, তবু বাঙালিদের ভাত খাওয়ার অভ্যাসে পরিবর্তন হয়নি। ভাত
বাঙ্গালীর একটি সাংস্কৃতিক ভিত্তি। বাঙালিরা কোনদিন কোন রেজিমেন্টেড ধর্মাদেশ দিয়ে পরিচালিত হয় নি।
হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন প্রভৃতি রেজিমেন্টেড ধর্মগুলির উৎপত্তি-স্থান থেকে বঙ্গভূমি বহু দূরে
অবস্থিত ছিল, সেই কারণে এই সব ধর্মের কোনোটাই তার আদি এবং অকৃত্রিম রূপে এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি।
তদুপরি, এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের সমন্বয় ঘটেছে। এভাবে
বঙ্গদেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন এবং ইসলাম ধর্ম তাদের মৌলিকত্ত্ব হারিয়ে বঙ্গীয় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ মানবিক
ধর্মে পরিণত হয়েছে। তাই এখানে সাম্প্রদায়িকতা শেষসত্য হিসেবে কোনদিনই প্রতিষ্ঠিত হয় নি।

ছবি : গুগল
(২)
‘আমি বাংলাকে ভালোবাসি
আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে আসি’
বৃহত্তর বঙ্গভূমির জনজাতিদের ধর্মবিশ্বাস কোনদিনই কোন অটল স্থির প্রজ্ঞার উপর নির্ভর করে
প্রতিষ্ঠিত হয় নি। আজ পর্যন্ত ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাগুলিকে শাসকের
পরিকল্পিত প্রয়াসের ফল হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায় নি। এই বাংলাভূমি ছিল সবচেয়ে বেশি মুসলমান শাসনের
অধীন। কিন্তু সেই মুসলমানত্বের মতাদর্শ যতটা না আরব থেকে আমদানীকৃত কোরাণনির্ভর নির্দেশিকা
ছিলো , তার চেয়ে বেশি ছিল ইরানি সংস্কৃতির মুক্তচিন্তার অনায়াস প্রতিফলন। এই প্রসঙ্গে বাঙালির
দর্শনচেতনায় ইরানি সংস্কৃতির প্রভাব নিয়ে একটু আলোচনা দরকার। হজরত মহম্মদের পরবর্তী খলিফাদের
শাসনকালে আরবরা যেসব দেশ জয় করেছিলেন, সেগুলির মধ্যে ইরানের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। মধ্যযুগের
মুসলমান পন্ডিত, দার্শনিক, এবং শাস্ত্রবিদেরা অনেকেই ছিলেন ইরানি। এঁদের মধ্যে দু’একজনের নাম উল্লেখ
করলেই ইরানি সভ্যতা ও সংস্কৃতির সম্যক পরিচয় পাওয়া যাবে। ইরানি সংস্কৃতির অন্যতম ব্যক্তিত্ত্বদের
মধ্যে রয়েছেন, বীজগণিতের পিতা বলে পরিচিত অঙ্কশাস্ত্রবিদ আল-খওয়ারজমি(৭৮০-৮৫০), পৃথিবীর
ইতিহাসে মহান চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত আল-রাজি (৮৫৪-৯২৫), ভারততত্ত্ববিদ দার্শনিক আল-বিরুনি
(৯৭৩- ১০৫০), মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইতিহাসবিদ ইবিন সিনা (৯৮০-১০৩৭), সর্ববিদ্যাবিশারদ কবি
ওমর খৈয়াম (১০৫০-১১২৩), অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুফি কবি জালালউদ্দীন রুমি (১২০৭- ১২৭৩) প্রমুখ। সমগ্র
ভারতবর্ষ তথা এই বাংলায় সুফিবাদের যে চর্চা অব্যাহত ছিল তা আসলে ছিলো ইরানি সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ
প্রভাব। ভারতে কাদিরিয়া এবং চিসতিয়া ঘরানার অনুসারীরাই ছিল সংখ্যাবহুল। এই দুই ঘরানার আদিগুরু
যথাক্রমে আবদুল কাদির জিলানি এবং খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি। এঁরা দুইজনেই ছিলেন ইরানের মানুষ। বাংলার
প্রথম স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ (রাজত্বকাল ১৩৪২-১৩৫৭) ছিলেন জাতে ইরানি। তাঁর আগে
বখতিয়ার খিলজির সময়ে যে দুইজন ইরানির বাংলায় পা পড়েছিলো তাঁরা হলেন, বাবা কোতোয়াল ইস্পাহানি এবং
কাজি রুকনুদ্দিন সমরকান্দি। বোঝাই যাচ্ছে এঁরা ছিলেন কর্মসূত্রে কোতোয়াল এবং কাজি। পরবর্তিতেও
সুলতানি ও মোঘল আমলেও অসংখ্যজন ইরানি বংশোদ্ভূত রাজকর্মচারী, কবি, ধর্মতাত্ত্বিক, সুফি এই
বাংলায় এসেছেন। বাংলায় সুলতানি শাসনের প্রথমদিকে তিনজন প্রধান সুফি সেখ জালালউদ্দীন তব্রিজী,নূর
কুতুব আলম, এবং শরফুদ্দীন আবু তওয়ামা এঁরা প্রত্যেককেই এসেছিলেন ইরান থেকেই। তেরো শতকের
ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দীন যাঁর বই ‘তবাকত-ই-নাসিরি’ ছাড়া বাংলার মুসলমান শাসনের আদি-পর্বের ইতিহাস
জানাই যেত না, তিনিও ইরানের মানুষ। আসলে এই বাংলার ইসলামে যে উদারনৈতিক চেহেরার সঙ্গে আমরা
পরিচিত তা শরিয়ত নির্ভর আরবীয় সংস্কৃতি নয়, তা অনেকটাই সুফিনির্ভর ইরানীয় সংস্কৃতির ফসল।
মধ্যযুগে সুফিবাদের মতো ভক্তিবাদী দর্শনেরও প্রসার ঘটে এই বাংলায়। হিন্দু সমাজে ভগবৎপ্রেম ও
ভক্তিবাদ আশ্রিত বৈষ্ণবধর্ম বিদ্যমান থাকলেও সুফি মতবাদের উদার মানবপ্রেম ও সাম্যনীতির আদর্শ
যুক্ত করে চৈতন্যদেব একে একটি নব্য ভাববাদী ধর্মমতের রূপ দেন। মধ্যযুগে বিভিন্ন বর্ণশ্রেণিতে বিভক্ত
হিন্দু সমাজে চৈতন্যদেবের এই মতবাদ ছিল কল্পনাতীত। তখন সমাজের উচ্চ কোটিতে ছিল ব্রাহ্মণ, আর
নিম্ন কোটিতে শূদ্র। ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের সামাজিক-সাংস্কৃতিক অধিকারে আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। তুর্কি
বিজয়ের পর হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারের কঠোরতা আরও বৃদ্ধি পায়। এইরকম অবস্থায়
চৈতন্যদেব চণ্ডাল, মুচি, ম্লেচ্ছ, বৈশ্য, কায়স্থ, ব্রাহ্মণ সকল বর্ণের মানুষকে কৃষ্ণের প্রেমমন্ত্রে ডাক
দিয়ে ঐক্যসূত্রে বাঁধার চেষ্টা করেন। চৈতন্যদেব নিজের জীবনে অনুশীলন করে তবেই সেটাকে অন্যের কাছে
অনুসরণযোগ্য করে তুলতেন। চৈতন্যভাগবতে আছে : নবদ্বীপে নগরভ্রমণ উপলক্ষে তিনি প্রথমে তন্তুবায়ের
গৃহে যান এবং তার দান হিসেবে নববস্ত্র গ্রহণ করেন। পরে গোয়ালার ঘরে দধিদুগ্ধের মহাদান গ্রহণ করেন।
এ ভাবে তিনি গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, মালাকার, তাম্বলী সকলের ঘরে গিয়ে তাদের আন্দোলনের শরিক করেন।
তিনি যে জাতিভেদ মানতেন না এবং জাতিচ্যুত হওয়ার ভয়ও করতেন না, এ সব দৃষ্টান্তে তার প্রমাণ পাওয়া
যায়। শ্রীচৈতন্য জাতিভেদের কঠোরতা শিথিল করেন। তাঁর কাছে শাস্ত্রের চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল
বেশি। তাঁর পরিকর-পার্ষদবর্গের মধ্যে ব্রাহ্মণ (রূপ গোস্বামী, সনাতন গোস্বামী, জীব গোস্বামী), বৈদ্য
(মুরারি গুপ্ত, অদ্বৈত আচার্য), কায়স্থ (রঘুনাথ দাস, নরোত্তম দাস), যবন (হরিদাস), সুবর্ণবণিক (উদ্ধারণ
দত্ত), সদগোপ (শ্যামানন্দ দাস) প্রভৃতি বর্ণ বা গোত্রের ব্যক্তিরা ছিলেন। তাঁর প্রেমভক্তিবাদে সমাজের
সব স্তরের মানুষের সমাবেশ ঘটেছিল। সে কালের বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের প্রেক্ষাপটে বৈষ্ণবরা এ ক্ষেত্রে
বৈপ্লবিক চেতনার পরিচয় দেন।
চৈতন্যদেব একদিকে যেমন বিরাজমান হিন্দু অভিজাতদের ম্লেচ্ছাচার রোধ করেন, অপরদিকে
নামসঙ্কীর্তনের মাধ্যমে সর্বসাধারণকে নব্য প্রেমধর্মে সমান অধিকার দেন। এভাবে তিনি উচ্চ ও
নিম্নবর্গকে অভিন্ন ধর্মাচরণ ও ভাবাদর্শে পরস্পরের সন্নিকটে এনে এক আত্মীয়ভাবাপন্ন উদার মানবিক
সমাজ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। চৈতন্যদেবের ভক্তিবাদের পথ ধরেই ক্রমে বৈষ্ণব, সহজিয়া, বাউল, কর্তাভজা
ও সখীভাবকের মতো ধর্মীয় সম্প্রদায় আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মসমন্বয়ের পথ বেয়েই পর
সত্যপীর/সত্যনারায়ণ এবং দক্ষিণ রায়/বড় খান গাজীর মতো লৌকিক দেবতা নির্ভর সাহিত্য রচিত হয়। এই
ধরণের সমন্বয়বাদী সাহিত্য বাঙালিত্বের ধারণাকে পরিপুষ্ট করছিলো। এ রকম এক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ
ধর্ম এর আগে কখনও বঙ্গীয় সমাজে ছিল না।

ছবি : গুগল
(৩)
‘বাংলার মাটি বাংলার জল
বাংলার বায়ূ, বাংলার ফল ...’
আজও এই বাংলায় নাম পরিচয়ে হিন্দু বা মুসলমান বলে চিহ্নিত হয়েও যাঁরা উদার মানবতাবাদের চর্চাকে
যাপনের শর্ত করে তুলেছেন তাঁরা আসলে কেউ সনাতন-হিন্দু বা শরিয়তী-মুসলমানের বিধান মেনে চলেন
না। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখি, খোদ মক্কার বুকে হজরত মহম্মদ যখন খলিফার পদে আসীন হয়েছেন
তখন বাংলা শাসন করছেন শশাঙ্ক। তখনও ইসলাম ধর্ম তার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্র চরিতার্থ করতে আরবের বাইরে বেরোতে
পারে নি। আরবের বাইরে ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছিল মহম্মদ পরবর্তী খলিফাদের সময়ে। তাই বলা যায়, এই বাংলার
প্রাক-ইতিহাসে ইসলামিক প্রভাব ছিলো না। শশাঙ্কের মৃত্যুর পরবর্তী একশ বছর বাংলায় কোনো স্থায়ী শাসক ছিলো না
বললেই চলে। সমগ্র দেশ অভ্যন্তরীণ কলহ- কোন্দলে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন এবং বৈদেশিক আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়েছে। এই অবস্থাটি
ইতিহাসের পাতায় ‘মাৎস্যন্যায়’ নামে চিহ্নিত। জনগণের নির্বাচনে গোপাল রাজা নির্বাচিত হন। ইতিহাসের
পাতায় তিনিই প্রথম গণতান্ত্রিক রাজা। এই গোপালের নামের সূত্র ধরেই পাল বংশের সূত্রপাত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী
পালদের দীর্ঘ শাসন বাংলায় এক ধরনের উদার ধর্মীয় আবহ সৃষ্টি করে। পাল যুগের সামাজিক ও ধর্মীয় পরিমন্ডল সহিষ্ণুতা
নীতি এবং পারস্পরিক সহ-অবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং এ মনোভাব বাংলার ইতিহাসে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলে।
শিল্পকলার ক্ষেত্রে বহুবিধ সাফল্যের জন্যও পালযুগ গুরুত্বপূর্ণ। বৌদ্ধ বিহারের স্থাপত্যরীতির চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়
পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারে। এ স্থাপত্যরীতি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহের পরবর্তী স্থাপত্য কাঠামোকে প্রভাবিত
করে। বাংলার পোড়ামাটির ফলক শিল্প এ যুগে চরম উৎকর্ষ লাভ করে। পালদের ভাস্কর্য শিল্প পূর্ব-ভারতীয় শিল্প রীতির
একটা বিশেষ পর্যায় হিসেবে স্বীকৃত হয়। পাল যুগেই বাংলার ভাস্কররা তাদের শৈল্পিক প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে সক্ষম
হন। বলা বাহুল্য, এই বৌদ্ধধর্মের অনুসৃতিতেই বাংলার অবতলবাসী প্রান্ত্যজ মানুষের মধ্যে এক সহজিয়া
জীবনদর্শন গড়ে উঠেছিল যার প্রকাশ আমরা চর্যাপদগুলিতে লক্ষ্য করি। এই সহজিয়া জীবনদর্শন
মূলগতভাবে ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী এবং মাটির কাছাকাছি থাকা প্রাকৃতজনের সাধনসঞ্জাত। পরবর্তীতে
বাংলার মাটিতে উজ্জীবিত সহজিয়া দর্শনের অভিনব পরিণমণ ঘটেছিল সুলতানি আমলের বাংলার সংস্কৃতিতে।
ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিক থেকে চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই বৃহত্তর বঙ্গ আসলে দিল্লী
সালতানাতের অধীনে ছিল। চতুর্দশ শতের মাঝামাঝি নাগাদ আফগান (পাঠান) সুলতান ফখরুদ্দীন মুবারব
শাহ্ বাংলার প্রায় সমস্ত অঞ্চল জয় করে খন্ড জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং এই ভূ-খন্ডে স্বাধীন
সুলতানী যুগের সূচনা করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান “শাহী বাঙ্গালা” উপাধী ধারণ করেন। পরবর্তী প্রায়
দুশ বছর এই পাঠান সুলতানরা রাজত্ব করেন। এই সব পাঠান সুলতানরা বহিরাগত হলেও এ দেশের মাটি ও
মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন,কারণ তারা কেউই শরিয়তি ইসলামের চর্চা
করতেন না। হুসেন শাহী আমলে বাংলার ভাবজগতে এক অভুতপূর্ব আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। একদিকে
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ফলে উত্তরিত ভক্তিবাদ ও অন্যদিকে মরমী সুফি সাধকদের দ্বারা প্রচারিত আধ্যাত্মিক
মানবতাবাদ বাংলার গোটা সমাজ জীবনকে উজ্জীবিত করে তুলেছিল। গোড়া পত্তন হয়েছিল এক নতুন
সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতির যার নিদর্শন সমকালীন বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যায়। বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব ধারার
উৎসার ঘটেছিল এই সময়েই। সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মহাভারত’ ও ‘ভগবদ গীতা’ প্রথমবারের মত
সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়। বস্তুত এই সময়কাল থেকেই বাঙালির জীবনে এই উদার
সমন্বয়ধর্মী মানবতাবাদী ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করেছিল যার পরিচয় পাওয়া যায় সে কালের কতিপয়
তথাকথিত নামপরিচয়ে হিন্দু বা মুসলমান কবিদের রচনায়।
“শুনহ মানুষ্ ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য,
তাহার উপরে নাই”
পনের শতকের বৈষ্ণব কবি চন্ডিদাসের এই অমর বানীতে যেমন আমরা মানবতাবাদের জয়গান শুনতে পাই
তেমনি সাতের শতকের অন্যতম কবি আবদুল হাকিম রচিত ‘নূরনামা’য় এক উদার সমন্বয়ধর্মী মতাদর্শের
প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়। তিনি বলেছেন,
“য়াল্লা(আল্লাহ) খোদা-গোঁসাই
সকল তান (তাঁর) নাম
সর্বগুনে নিরঞ্জন প্রভু গুনধাম।”
এইভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব ধারা নির্মিত হতে থাকে।
এই বৃহত্তর বঙ্গের মানুষের জীবন ধারা ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন কতকগুলি ইতিহাস লালিত দিক আছে
যেগুলি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের সাথে মেলে না। উনিশ শতকের মরমী সাধক ফকির লালন শাহ আসলে আমাদের
প্রতিপাদ্য বিষয়ের সবিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হতে পারেন।লালনের জাত বিষয়ক শানিত চিন্তার কথা
আজ সকলের জানা। জাত-পাত, উঁচু-নিচু, ইতর-ভদ্র, হিন্দু- মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান ইত্যাদি ভেদাভেদকে
তিনি অতিক্রম করেছেন। এ সমস্ত ভেদাভেদের উর্ধ্বে উঠে তিনি একীভূত মানব সমাজের কল্পনা করেছেন।
জাত-পাত কে তিনি একদমই থোড়াই কেয়ার করেছেন। তাই তো তিনি বলছেন- ‘জাত গেল জাত গেল
বলে / একি আজব কারখানা/ সত্য কাজে কেউ নয় রাজি / সবই দেখি তানা নানা’। জাত-ধর্ম পরিচয়ের
অসাড়তা প্রমাণের জন্য পাতার পর পাতা থিয়োরি লিখে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা যা করতে পারেন নি।
সহজিয়া জীবনদর্শনের মধ্য দিয়ে তার চেয়ে অনেক প্রগাঢ় মানবতার অনুশীলনকে সহজ যাপনসাধ্য করে দিয়ে
গেলেন লালন সাঁই।
(৪)
‘স্বদেশেরে চাও যদি তারো ঊর্দ্ধ্বে ওঠো/
কোর না দেশের কাছে মানুষেরে ছোটো’
ইতিহাসের গতিপথেই একসময় এই বাঙলার প্রবেশতোরণ দিয়েই প্রবল প্রতাপশালী ইংরেজরা প্রবেশ করেন এবং
এক দীর্ঘস্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলে পাশ্চাত্য যুক্তিবোধের আলোকে আধুনিক রাষ্ট্রনীতির অনুশীলনের ক্ষেত্র
প্রস্তুত করেন। একটি জনপদের সুদীর্ঘ ইতিহাসের গতিপথে স্বদেশের প্রতি আবেগ এতকাল শুধু একটি
ভূগোলের মৃত্তিকা, জলবায়ূ ও নিসর্গনিষ্ঠ মানুষের যাপনবাস্তবতা দিয়েই নির্ধারিত হয়ে আসছিল। এই প্রথম
একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিপ্রেক্ষিতে স্বদেশপ্রেমের স্থানে জাতীয়তার বোধ প্রতিস্থাপিত হতে শুরু
করলো। একদিকে ঔপনিবেশিক ইংরেজদের কার্যকলাপে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতি, আর অন্যদিকে তারই
বিরোধীতায় জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারণা আরোপিত হতে শুরু করলো এই ভূখন্ডের ভূমিলগ্ন মানুষের
উপরে। ক্রমে ভারতবর্ষের অভিজাতবর্গের জাতীয়তাবাদি চেতনার আঘাতে এই বাংলার সংস্কৃতির মৌলিক
উপাদানের জনক ভূমিসংলগ্ন প্রান্তিক মানুষের নিজস্ব চেতনা খর্বিত হলো। অনেকেই মনে করেন জাতীয়তাবাদি
নেতাদের আদর্শ ও অনুপ্রেরণার স্পর্শ পেয়েই এই বাংলার লোকায়ত জনতার প্রকৃত রাজনৈতিক চেতনা জাগ্রত
হয়েছিলো। কিন্তু এটাই সর্বপ্রণিধাণযোগ্য প্রকৃত ঘটনা ছিলো না। একটি আধুনিক রাষ্ট্রের জাতীয়তাবাদী
চেতনার সাথে এই বাংলার ভূমিজ মানুষের স্বভূমিচেতনা ছিলো গুণগতভাবে পৃথক। তাই তথাকথিত
বাংলাভাগের পরও দুই বাংলার মানুষের অনুভবময়তার জগতটি অভিন্ন থেকে গেছে। রাষ্ট্রতান্ত্রিক
জাতীয়তাবাদের রথচক্রে পিষ্ট হয়েছে বাঙালির কোমল স্বভূমিচেতনা। রাষ্ট্রনির্ধারিত জাতীয়াতাবাদী নির্দেশিকার
কবলেই আজ লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে স্বভূমিতেই বিদেশী হিসেবে চিহ্ণিত হয়ে রাষ্ট্রহীন নাগরিক হওয়ার যন্ত্রণার শিকার হতে
হচ্ছে ৷ ইতিহাসের মর্মান্তিক গতিপথে বাঙলার নিজস্ব এলাকাকে কেটে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বিভিন্ন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত
করার কুটিল রাজনৈতিক চক্রান্তের ফলে বাঙালী আজ নিজভূমে পরবাসী হয়ে গেছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে এবং আসামে
এনআরসি-র ভয়ে মানুষ আত্মহত্যা করছেন, অথচ কত আগেই ঋত্বিক ঘটক প্রশ্ন তুলেছিলেন, “বাংলার আবার এপার
ওপার কী?”
জুলফিকার জিন্না
বোলপুর, বীরভূম
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Commentaires