//azoaltou.com/afu.php?zoneid=3651748 //azoaltou.com/afu.php?zoneid=3683887
top of page
Search

মাদ্রাসা শিক্ষার সেকাল একাল


ree

সা'আদুল ইসলাম

মাদ্রাসা শব্দটি আরবি, যেখানে 'দারস' অর্থাৎ পাঠ দান করা হয়, শিক্ষাগার। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স) প্রথম শিক্ষদাতা। আর শিক্ষালয় হল মক্কার অদূরে পর্বত সমাকীর্ণ দুর্গম গলিপথে অবস্থিত ইবনে রকিমের বাড়ি, 'দারে আরকাম'।


আরকাম ইবনে আবী আল আরকাম মাখযুমী (রাজি)। কারণ, ইসলামের নবীজীর এক আল্লায় আহ্বানের প্রথম লগ্নে কোরায়েশদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে নবীজী দুচারজন সঙ্গী নিয়ে মিলিত হতেন এই দুর্গম স্থানে অবস্থিত বাড়িটিতে। সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের সানুদেশে সা ঈ করার সময় এই বাড়ি থেকে বাইরে দেখা যেত, গলিটিতে প্রবেশের মুখটি সংকীর্ণ ছিল বলে বাড়িটি নিরাপদ মনে করতেন নবীজী ও তাঁর সঙ্গীরা। সেখানেই সঙ্গীদের শিক্ষা দিতেন মহানবী। ইসলামের শিক্ষার ইতিহাসে 'দার-এ- আরকাম' তাই মাদ্রাসাব্যবস্থার প্রথম সোপান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ।


মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের পরে মসজিদে নববীর পূর্ব পাশে 'আহলে সুফফা'দের (আবাসিক প্রিয় সহচরগণ) মধ্যে শিক্ষাদান করা হতো। শিক্ষক উবাদা ইবনে সামেত। শিক্ষার্থী ছিলেন আবু হোরায়রা, মুয়াজ ইবনে জাবাল, আবু জার গিফারী (রাযি) প্রমুখ অনেক বয়স্ক সাহাবী।


মাদ্রাসা শিক্ষার গোড়ার কথা, আগে মানসিক প্রস্তুতি ও শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। ক্রমে খলিফাগণ নানা দিকে মাদ্রাসা স্থাপন করেন। হযরত আলি (রাযি) মাদ্রাসা স্থাপন করেছেন কুফায়। পরবর্তীকালে খলিফাগণ দরবারে পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার উজাড় করে দেন পৃথিবীবাসীর কাছে। স্পেন বিজয়ের পরে কর্ডোভার কথা কে না জানে? এদিকে আব্বাসী দরবারে বসে চরক সুশ্রুত-র মতো ভারতীয় সংস্কৃত গ্রন্থের অনুবাদ ও ভেষজ বিদ্যার চর্চা, গণিত, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সঙ্গে 'পঞ্চতন্ত্র' অনুবাদ হচ্ছে 'কলীলাহ ওয়া দিমনাহ' নামে। অর্থাৎ রসসাহিত্যের চর্চা হচ্ছে। ইসলামের ভাবনায় রয়েছে এই বিশ্বাস -- জ্ঞান হচ্ছে পানি। পানির অপর নাম জীবন। তাতে কোন বাঁধ নেই, বাধা নেই। শিক্ষায় বাধা দেয় মানবতার শত্রুরা। আর যারা লাইব্রেরি পোড়ায়? … তারা শত্রু সভ্যতার।


কারণ, ইসলামের প্রথম ঐশী বাণী ই হচ্ছে - ' ইকরা বিসমি রব্বিকাল্লাযী খালাক্ব্ ; পড়ো বিশ্বজগতের প্রভুর নামে।' পড়ো শব্দটি প্রথম শব্দ কোরআনের এবং ইসলামের। খলিফাদের আমলে মাদ্রাসা স্থাপিত হয়েছে আর তৈরি হয়েছে লাইব্রেরি। গবেষণাগার, মহাকাশ গবেষণায় মানমন্দিরও। কিন্তু সেকথা পরে।


কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়েছে মসজিদ থেকেই কোরআনিয়া মাদ্রাসা কিংবা মক্তবের নামে যে প্রাথমিক শিক্ষার ধারা চলে এসেছে কয়েকশো বছর ধরে তা মসজিদকেন্দ্রিক। ইসলামের ইতিহাসে হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তার সাহাবীরা রাযিয়াল্লাহু আনহুম মসজিদে বসেই তালিম নিয়েছেন, কখনো কারো বাড়িতে শিক্ষাদাতা কোন ব্যক্তি হাজির হয়েছেন অন্যেরা বসে শিক্ষাগ্রহণ করেছে। নারীদের শিক্ষার জন্য পুরুষরা মসজিদের শিখেছেন বাড়িতে গিয়ে সেই তালিম তারা করতেন মহিলাদের এবং সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে। মোটামুটি এই ছিল খোলাফায়ে রাশেদার আমলের শিক্ষাধারা।


উমাইয়া আমলে মূয়াবিয়া (রাযি)-র সময়ে দামেস্কে মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে, কিছু গণিত, ভূগোল, হস্তলিপি বা ক্যালিগ্রাফি, ইসলামের আকিদা বা প্রারম্ভিক দর্শন, ইসলামী আদব কায়দা, কিছু পরিমাণে ব্যাকরণ ও লজিক এই মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষাদানের বিষয় ছিল।


ভিন্ন স্থান থেকে কখনো ইরানীয় কখনো বা অন্য কোন দেশের মানুষ এসে উপস্থিত হওয়ায় আরবি ভাষার ভিতরে যে বিমিশ্রতা তৈরি হয়, তার থেকে বাঁচানোর জন্য আরবি শিক্ষার উপরে, পাঠ ও উচ্চারণশৈলীর শিক্ষাদানের উপরে গুরুত্ব দেওয়া হতো। হযরত মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে সিরিয়াতে দামেশকে। উচ্চতর শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল, 'বায়তুল হিকমাহ' (এর নামও বায়তুল হিকমাহ) নামে গ্রন্থাগার। বিভিন্ন ভাষার রচিত মূল্যবান গ্রন্থগুলির সংগ্রহ, গ্রিক পারসিক এবং ভারতীয় ভাষা সংস্কৃত থেকে অনুবাদ হয়েছে উমাইয়া খলিফাদের শেষের দিকে।


বায়তুল হিকমাহ


প্রকৃতপক্ষে, ঐকান্তিক জ্ঞানচর্চার স্রোত বয়ে যায় অষ্টম শতাব্দীতে বাগদাদে বসে আব্বাসীয় খলিফাদের আমলে। ৭৫০ খ্রিস্টাব্দ উমাইয়া শাসনের অবসান ও আব্বাসিয়া শাসন শুরু। আল-মনসুর ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে রাজধানী স্থাপন করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জ্ঞানী-গুণীদের সেখানে আমন্ত্রণ জানান। খলিফা হারুনুর রশিদ ( শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯) এবং তাঁর পুত্র আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩) এদের শাসনকালে 'বাইতুল হিকমাহ' ( House of Wisdom) শুধু বিজ্ঞানভবন নয়, সারা পৃথিবীর কাছে স্বর্ণযুগের জ্ঞানভাণ্ডারের পরিচয় তুলে ধরে। গ্রিক পারসিক ও ভারতীয় ভাষার জ্ঞান আহরণ করে, অনুবাদ কর্মের মাধ্যমে ও মৌলিক গবেষণার মধ্য দিয়ে বায়তুল হিকমাহ প্রকৃতই এক স্বর্ণযুগ সৃষ্টি করে শিক্ষাক্ষেত্রে। বিজ্ঞান চর্চায় চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত, অ্যালজেবরা এবং নানা প্রকৌশলী যন্ত্র উদ্ভাবন ইত্যাদি ক্ষেত্রে এক অসামান্য অগ্রগতি শুরু হয়।


মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল খোয়ারিজমী (৭৮০-৮৫০) রচিত 'কিতাব আল জাবর ওয়াল মুকাবলা' (যার থেকে বীজগণিত কে অ্যালজেবরা বলা হয়) এবং তার 'অ্যালগরিদম' সূত্র উদ্ভাবন, আরব জগতে হিন্দু সংখ্যা পদ্ধতির প্রচলন, যা পরে ইউরোপে পৌঁছায়, বিশেষ উল্লেখযোগ্য। আহমদ ইবনে মুসা ইবনে শাকিব ছবিসহ যন্ত্র- বিষয়ক বই পূর্ণাঙ্গ বর্ণণা সহকারে প্রকাশ করেন। আহমদ ইবনে মুসা ও তার ভাতৃদ্বয় আহমদ ইবনে মুসা ও হাসান ইবনে মুসা (তাদেরকে একত্রে বলা হতো বুনু মুসা) বিখ্যাত প্রকৌশলী ছিলেন। গ্রন্থটির নাম 'কিতাবুল হিয়াল'।


পদার্থবিজ্ঞানে মুহাম্মদ জাফর ইবনে মুসা মুহাম্মদ মুসা পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বিশ্বজনীনতার কথা প্রথম বলেন।


চিকিৎসা বিজ্ঞানে হুনায়ন ইবনে ইসহাক চক্ষুরোগ বিষয়ে আলোকপাত করেন। অন্যান্যরা গুটিবসন্ত ও সংক্রমণ বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেন। এবং সেই যুগে শল্যচিকিৎসা বা অস্ত্রোপচারের ব্যবস্থা করেন চিকিৎসক।


আলকেমি বা রসায়ন বিজ্ঞানে আল কিন্দী (৮০১-৮৭৩)-র নাম উল্লেখযোগ্য। এই মহাবিজ্ঞানী প্রতিভা বিজ্ঞানের নানা শাখায় রসায়ন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, আবহবিজ্ঞান ও মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে পেরিপ্যাটেটিক দর্শনেরও পুরোধাপুরুষ ছিলেন। জ্ঞানের ব্যাখ্যায় আল কিন্দী তিনটি বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেন। ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও কল্পনা। ইন্দ্রিয় মাধ্যমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হয়, বুদ্ধির সাহায্যে প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া যায় এবং কল্পনা এই দুইয়ের সমন্বয় সাধন করে। ইমানুয়েল কান্টের সমন্বয়বাদী জ্ঞানতত্ত্ব-এর সঙ্গে আল কিন্দীর দর্শনচর্চার যোগসূত্র দেখতে পাওয়া যায়। কান্ট বুদ্ধিবাদ ও অভিজ্ঞতাবাদের সমালোচনায় এক সমন্বয়ক আবিষ্কার করেন, এর নাম দেন সমীক্ষণবাদী বুদ্ধি। কান্টের ৯০০ বছর আগে আল কিন্দী অনেকটা এরকম তত্ত্ব প্রচার করেছিলেন। তিনি কম্পাঙ্ক বিশ্লেষণ পদ্ধতির আবিষ্কর্তা এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানে সংগীত থেরাপির প্রয়োগকারী ছিলেন। গুপ্ত সঙ্কেতের মর্মোদ্ধারের জন্য গাণিতিক পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা পরবর্তীকালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গৃহীত হয়েছে।


ইবনে সিনা (আনু. ৯৮০-১০৩০) প্রাক-আধুনিক যুগে সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তিনি একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও মনোবিজ্ঞানী। তাঁর লেখা ৪৫০ বইয়ের মধ্যে ২৪০ টির সন্ধান মেলে। ১৬৫০ খ্রি. পর্যন্ত তাঁর চিকিৎসা বিজ্ঞান (চিকিৎসাবিষয়ক বিশ্বকোষ) সারা ইউরোপে পাঠ্য ছিল বলে কথিত। ইবনে সিনার অতি বিখ্যাত বই হল 'আল কানুন ফিত তিব' ও 'কিতাবুশ শিফা'। "শিশুদের প্রশিক্ষণ ও লালন পালনের ক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা" শীর্ষক আলোচনায় শ্রেণীভিত্তিক শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। আলোচনা ও পারস্পরিক অনুসরণের মধ্যে শিশুদের শিক্ষা কার্যকরী হয়ে ওঠে। দুটি স্তর কল্পনা করেছেন : ৬ বছর বয়স থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা এবং ১৪+ বছরের ঊর্ধ্বে উচ্চতর স্তর। এই স্তরে কোরআন, হাদিস, ইসলামী দর্শন ভাষা, সাহিত্য ইসলামী আচার-ব্যবহার এবং ব্যবহারিক বা প্রায়োগিক দক্ষতা অর্জন করার ব্যবস্থা দিয়েছেন। যা কর্মক্ষেত্রে তাদের স্বনির্ভর হতে সাহায্য করবে। তাদের তিনি ইচ্ছামত বিষয় নির্বাচন, বৃত্তিনির্ভর শিক্ষা আর এমন সংবেদনশীল বয়সে তাদের প্রতি নমনীয়তা ও তাদের মানসিক বিকাশ বিবেচনায় রাখা দরকার বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেন।


ভারতীয় গ্রিক ও পার্শিয়ান রচনা ব্যবহার করে জ্ঞান বৃদ্ধির চেষ্টা চলে বাগদাদে। ত্রয়োদশ শতকে 'মেটেরিয়া মেডিকা'র আরবি অনুবাদ হয়। কিন্তু এই বিশাল অনুবাদকর্মের মধ্যে প্রথমটি হলো অ্যারিস্টোটলের 'টপিক' গ্রন্থের অনুবাদ। তারপর পিথাগোরাস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হিপোক্রেটিস, ইউক্লিড, আর্যভট্ট, এবং ব্রহ্মগুপ্তের লেখার অনুবাদ।


খলিফা আল মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩) আকাশ বিজ্ঞান গবেষণার জন্য মানমন্দির স্থাপন করেন। শামাসিয়া অঞ্চলে ৮২৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপন করেন 'মুমতাহান মানমন্দির'। দ্বিতীয় মানমন্দিরটি দামেশকে কাসিউন পর্বতে। "আল জিজ আল মুমতাহান" গ্রন্থে মানমন্দির বিষয়ক পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করে রাখা আছে। জিজ হল টেবল বা সারণী, গোটা বইটিতে সারণীর মাধ্যমে মানমন্দির গবেষণা - পর্যবেক্ষণ ধরে রাখা হয়েছে।


শিক্ষার সোনালী অতীত ধ্বংস হল হলাগু খানের হাতে


নবম থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত বিশ্বের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র ছিল। বায়তুল হিকমাহ মোঙ্গলদের সময় হলাগু খান বাহিনীর হাতে এই বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার ধ্বংস হয় মোঙ্গলদের বাগদাদ অবরোধের সময়। ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি থেকে ১০ ফেব্রুয়ারি, তেরো দিন ধরে বিপুল ধ্বংসক্রিয়া চলে। শেখ সাদী ১৫৫৮ সালে বিখ্যাত নিজামিয়া মাদ্রাসা ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেন।


দেখা গেল

১. মসজিদকেন্দ্রিক প্রাথমিক শিক্ষা মূলত কোরআন ও হাদিসের পাঠদান।

২. ব্যক্তি শিক্ষকের বাড়িতে গিয়ে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা।

৩. খলিফাজাদা ও ওমরাহ ও তাঁদের সন্তানদের শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষককে আমন্ত্রণ জানিয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা।

৪. অনেক ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা সরাইখানা স্থাপন করে তার সঙ্গে রোগ নিরাময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা ছাড়িয়ে উচ্চতর শিক্ষাদানের ব্যবস্থা গ্রহণ।

৫. কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য খলিফাদের বা ওমরাহশ্রেণীর অনুদানের ব্যবস্থাপনা।

৬. ক্রমে উচ্চতর শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় লাইব্রেরি স্থাপন, গ্রন্থসংগ্রহ ও সেগুলির অনুবাদ কর্ম চালানো এগুলির মাধ্যমে।

দশম শতাব্দীর পর মক্তব শব্দের ব্যবহার হতে থাকে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষালয় বোঝাতে।


জামেয়া আযহার


ফাতেমী বংশীয়দের ব্যবস্থাপনায় আল-আযহার (যা বর্তমানে জামেয়া আযহার) প্রতিষ্ঠিত হয় ৯৭০/৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে, কায়রো, মিশর। এটি মিশরের প্রাচীনতম শিক্ষাকেন্দ্র । আল মুইজ লিদ দীনিল্লাহ দ্বারা স্থাপিত। বিশ্ববিখ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি আজও সগৌরবে বিদ্যমান।


মাদ্রাসা শিক্ষার স্বর্ণযুগ থেকে বর্তমানের বিবর্ণ অবনমন


দারসে নিজামী আসলে নিজামিয়া মাদ্রাসার সিলেবাসের বিষয় ছিল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বর্তমানে ভারতে দারসে নিজামি নামে যে ইসলামী শিক্ষাধারা চলছে, তার সঙ্গে সম্পর্ক অবশ্যই রয়েছে। ভারতে এই নামের কোর্স চালু হয়েছে হিজরী ১১০০ সালের পরে। মোল্লা নিজামউদ্দিন সাহলভী (১০৮৮/৯৯ মুতাবিক ১৬৭৭/৭৮ খ্রিস্টাব্দে জন্ম) ১০০৫ হিজরি মুতাবিক ১৬৯৩-৯৪ খ্রি. অর্থাৎ ১৭শ শতকের শেষে, ইসলামী শিক্ষাকে ঢেলে সাজালেন, ১১টি বিষয় তার অন্তর্ভুক্ত ছিল। লখনৌতে আওরঙ্গজেবের দেওয়া জায়গীরে বসতি স্থাপন করেন, সেই সঙ্গে স্থাপন করেন মাদ্রাসায়ে নিজামিয়া, লখনৌয়ের অভিজাত 'ফিরিঙ্গি মহল' এলাকায়। এই সিলেবাস 'দারসে নিজামিয়া' নামে ভারতের বিভিন্ন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসায় চালু হয়। বিশেষ করে, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রভাবিত সকল মাদ্রাসায় এই সিলেবাস চলতে থাকে। ফলে মধ্যপ্রাচ্যের একাদশ শতাব্দীর বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসার সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অস্বাভাবিক নয়। তাই, বাগদাদে অবস্থিত নিজামিয়া মাদ্রাসার (কিংবা ভারতের লখনৌয়ের ফিরিঙ্গি মহলে'র মাদ্রাসা; এখানে স্মরণ করি, মোল্লা নিজামুদ্দিনের পূর্বপুরুষ হিরাট থেকে এসেছিলেন) বিবরণ এবং বর্তমানে এর সিলেবাসের যে অবনমন সংবর্জন ও অবমূল্যায়িত রূপটি চালু করা হয়েছে, এটা নিয়ে আলোকপাত করা দরকার, ভারতে বা বাংলার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা বিষয়ে।


বোঝা যাবে, দারসে নিজামী কোর্স নিয়ে কেন এই প্রতিবেদক এখনও মধ্যপ্রাচ্যে পড়ে আছেন। ইসলামী শিক্ষাধারার কাঠামোটি প্রায় অজর অমর অবস্থায় রয়ে গেছে, অনেক ছাল বাকল পত্র পুষ্প ঝরে গেলেও।


তার আগে কয়েকটি বিখ্যাত মাদ্রাসা নিয়ে আলোচনা থাকছে।


নিজামিয়া মাদ্রাসা প্রথম প্রতিষ্ঠিত নিজামিয়া মাদ্রাসাগুলোর অন্যতম। সেলজূক সাম্রাজ্যের উজির ও পারস্যের বিখ্যাত পণ্ডিত ও দার্শনিক আবু আলী হাসান আলী আল তুসী; ১০১৮-১০৯২) নিজামুল মুলক নামে আখ্যায়িত, তাঁর ব্যবস্থাপনায় ১০৬৫ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় এই শিক্ষাকেন্দ্র। তাই-ই মাদ্রাসা নিযামিয়া। এর সিলেবাস আসলে 'দারসে নিযামিয়া'। ১০৯১- এর জুলাই নিজামুল মুলক দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিক আল-গাজ্জালীকে এর অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দান করেন। তখন আল গাজ্জালীর বয়স ৩০ বছর। ১০৯৬ খ্রিস্টাব্দে গাজ্জালী যখন মাদ্রাসা ত্যাগ করেন তখন এখানে ৩০০০ ছাত্র ছিল। বিনামূল্যে শিক্ষাদানকারী এই প্রতিষ্ঠানটিকে মধ্যযুগের সবচেয়ে বৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বার্বার বংশীয় আল- মোহাদ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুমারত গাজ্জালী র অধীনে শিক্ষা লাভ করেন। ১১১৬ সালে মুহাম্মদ আল-শাহারিস্তানী সেখানে অধ্যাপক ছিলেন, ১১৭০-এর দশকে বাহাউদ্দিনও অধ্যাপনা করতেন। পারস্যের মরমী কবি, শেখ সাদী ১১৯৫-১২২৬ সাল পর্যন্ত এখানে শিক্ষালাভ করেন। তিনি যখন তার ৩০ বছরব্যাপী যাত্রা শুরু করেন, হালাকু খানের নেতৃত্বে মোঙ্গলদের হাতে এর ধ্বংস প্রত্যক্ষ করেন। ১২৫৮ সালে এই ঘটনা সংঘটিত হয়।

Makdiisi, George --madrasah and University in the middle age s, Studia Islamica, No 32 (1970), p. 255-264

Al -Ahram Weekly, Baghdad Supplement

Black, A -- a history of Islamic political thought from the prophet to the present, Cambridge edinburg University press 2001


এক বিশেষজ্ঞের উক্তি উদ্ধৃত করি --

Nizamul Mulk was perhaps the best administrator the Islamic world has known after the Caliph Omar bin al khattab ®. He streamlined the Abbasid administration, rationalized the tax collection system and stimulated the economy that had been battered by the loss of trade with the Mediterranean. But the Nizam is best remembered for starting and patronizing a string of universities in the Abbasid domains. The best known of these was the Nizamia College in Baghdad which attracted the renowned scholars of the age.

এর গৌরবধন্য সিলেবাস-এর এক নিষ্করুণ পরিণতি বিষয়ে যা বললেন এই প্রাজ্ঞ বিশ্লেষক --

Nizamia syllabus has survived almost a thousand years and it is sad reflection on the contemporary madaris that the same syllabus more correctly regressed version of it is still followed.

সিলেবাসের অবনমন বা পরিবর্তনের কারণ সন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেন --

The world went through the Crusades; the Mongol Devastations, the Discovery of America, the Rise and Fall of the Ottoman Empire, the Industrial Revolution,, the consolidation and disappearance of the British Empire, several moon landings and yet a shrunken version of the 'Nizamia Nisab' is taught in our school.


এতগুলি বিশ্ববিস্ময় ঘটনাধারা পৃথিবী দেখা সত্বেও নিজামিয়া সিলেবাস চলছে সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে অন্যান্য মাদ্রাসায়। কিন্তু অবনমন বা পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে নানা কারণে :

১. সর্বত্র 'দ্বীন' প্রাধান্য পাচ্ছে (Deen)

২. ফিকা আর ফতোয়া; আইন ও বিধান মরমিয়া ভাবনার উপরে জয়যুক্ত (fiqh & fatwa gained ascendancy over tasawwuf)

৩. রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা প্রাধান্য পেল (একটু রসিয়ে বলা যায়, রাষ্ট্রের পিঠে ছড়ির ঘা বা প্র -তাড়নার জ্বালায় রাষ্ট্র যা চায়, মানে রাষ্ট্রের চাহিদা); নাগরিক ও পুরসেবা দূরে সরে গেল (statecraft prevailed and civics were also dropped)

৪. যেহেতু ইউরোপীয় সংস্কৃতি ভারতের মাটিতে শিকড় চালিয়েছে; দর্শন ও গণিত মাদ্রাসা থেকে সরে গেল; কারণ এটা তো ফিরাঙ্গী থেকে চুইয়ে পড়া।

(As European culture sank roots on Indian soil, the study of philosophy and mathematics was also dropped from the madaris, in part because these subjects were considered trained from their contact with the firangees.)

মানে, একই রোগ; "ফিরাঙ্গী" অর্থাৎ ইউরোপীয় শিক্ষাধারা থেকে আগত বিদ্যা বলে মনে করা হলো। একসময় তো খ্রিস্টানি আর 'নাসারা বিদ্যা' বলে ইংরেজি শিক্ষা থেকে দূরে সরে ছিল, এখন অংক ও দর্শন থেকে। ভাগ্যিস, "খ্রিস্টানি" বলেনি?


মুসতানসিরিয়া মাদ্রাসা (১২২৭ খ্রি)

মধ্যযুগের উচ্চশিক্ষা ও বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিভাদীপ্ত কমপ্লেক্স ছিল এটি। আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতানসির ইরাকের বাগদাদে এটা প্রতিষ্ঠা করেন ২২২৭ খ্রিস্টাব্দে।

Mustansiria Madrasa was a mediaeval-era scholarly complex that provided a universal system of higher Education. It was established in 1227 CE and was named after and built by the Abbasid Caliph al-Mustansir in Baghdad, Iraq. (Wikipedia)


মাদ্রাসা আল-ফেরদাউস (১২৩৬)


সিরিয়ার রানী আল-মালিকা দাইফা খাতুন সম্পূর্ণ নিজ অর্থ ব্যয়ে সিরিয়ার আলেপ্পোতে ১২৩৬ সালে এই মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এই মাদ্রাসার ব্যয়বহনের জন্য অর্থ বরাদ্দ হত। এই কমপ্লেক্সের স্থাপত্যকর্ম বিশেষ প্রণিধানযোগ্য।

(Rana Jalabi Hodijk --"Al-Madrasa al-Firdaus in Aleppo : a chef-d'oeuvre of Ayyubid architecture", American University in Cairo, Dept of Arab and Islamic Civilization, 1988, p. 39.)


মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাচ্যে আসা যাক : ভারতে মাদ্রাসা বাংলায় মাদ্রাসা ব্যবস্থা।

দেখা যাবে সিলেবাসে বিপুল পরিবর্তন অবনমন।


ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা:

মক্তব বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা দিল্লি, লখনৌ, মাদ্রাজ, ঢাকা ইত্যাদি বড় বড় শহরে সুলতানি যুগে স্থাপিত হয়েছিল। এ দেশে মুসলমান আগমনের সঙ্গে সঙ্গে। মাদ্রাসার ইমারত প্রথম স্থাপিত হয় মুলতানে। এর নির্মাতা ছিলেন নাসির উদ্দিন কুবজা এবং এই মাদ্রাসার প্রধান ছিলেন মাওলানা কুতুব উদ্দিন কাশানি। শেখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানি ৫৭৮ হিজরীতে এই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের এই মহাপ্রাজ্ঞ বুজুর্গ ঐতিহ্যবাহী বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসায় অধ্যাপনার গৌরবজনক পদ অলংকৃত করেছিলেন।


সুলতানি আমলে (১২০৪/১২১০-১৫৭৬) মাদ্রাসা গুলির সিলেবাস ছিল এইরকম : আরবি, নাহু (বাগবিধি), সরফ (রূপতত্ত্ব), বালাগাত (অলংকার), মানতিক (যুক্তিবিদ্যা), কালাম (জ্ঞানতত্ত্ব), তাসাউফ (অতীন্দ্রিয়বাদ) সাহিত্য, ফিকাহ (আইন) ও দর্শন।

Maulana Abul Hasan Ali Nadvi in his manuskript 'Hindustan ki khadeem darsgahen' (Shibli Academy 1919), states that the syllabus of the madaris in the subcontinent during the 13th and 14th centuries included the following subjects:

Akhlaq & it's principles, Grammar, Oration, Hadith & its sciences, Arithmetic & Astronomy, Tasawwuf, Kalam.

মুঘল যুগে বিশেষ করে আকবরের সময় বহুজাতিক উদার ধর্মনিরপেক্ষ আবহাওয়ার কারণে সিলেবাসে বৈচিত্র্য ছিল।. The cosmopolitan culture of Mughal India included the Mughals, the Afghans, the Rajputs, the Persians, the Hindus and the Muslims. He even started his Sufi Tareeqa with himself at his head, called Deen e Ilahi which was misunderstood by the Muslims as a new religion. Through his policy of sulhe kul (peace between all groups) he sought to unify all the cultures of India under the Mughal banner….

মোগল, আফগান, রাজপুত, পারসিক, হিন্দু এবং মুসলমানকে সমন্বয়বাদী 'দীন-ই-ইলাহি' ও 'সর্ব স্বস্তি-শান্তি'র বার্তাবাহী 'সুলহি কুল'-এর মাধ্যমে একই মুঘল ছত্রতলে আনতে চেয়েছিলেন সম্রাট আকবর।

এই বহুজাতিক সমন্বয়বাদী ধর্মনিরপেক্ষ মানসতা মাদ্রাসার সিলেবাসের প্রভাব সঞ্চারিত করল।

The cosmopolitan character of the Mughals was reflected in the madaris of the age Gone was the narrow focus on the study of akhlaq and hadith. The Mughals instituted a broad based curriculum which included not only the religious sciences but also advanced mathematics, engineering, sociology and history . According to Nadvi, the Mogul madrassah curriculum included the following subjects:

Akhlaq and its principles, Literature and grammar, Law, Philosophy, Mathematics, Astronomy, Medicine, Kalam, Tasawwuf and The life of the Naqshbandi Shaikhs.


ধর্মীয় মাদ্রাসা গুলির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাকেন্দ্র রাজ্যে স্থাপিত হয়েছিল। সেই স্কুলগুলিতে ইঞ্জিনিয়ার শিল্পী-কারিগর, ডাক্তার ও প্রশাসকদের ট্রেনিং দেওয়া হতো। এখন সিলেবাস আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠলো এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশেষীকরণ করা হতে থাকলো। বিশেষ করে, ইতিহাস ও আত্মশুদ্ধির পাঠক্রম বিন্যাসে। বিশেষীকরণের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। (বন্ধনীর মধ্যে দেখুন)

The curriculum of these schools included the following subjects:

1. Akhlaq (good character, humility, respect for elders, etiquette. The text books used included Akhlaq e Nasiri and Akhlaq e Jalali)

2. Arithmetic 3. Astronomy 4. Astrology 5. Mathematics 6. Geometry

7. History (Shahnama e Firdowsi, Zafarnama of Sharfuddin Ali Tarmizi, Futuhat e Timuri, Akbar Nama, Iqbal Nama a Jahangeeri, Tareeq e Feroqe Shahi, Warzam Nama, Mahabharata)

8. Oration, 9. Medicine, 10. Economics 11. Sociology 12. Literature (prose poetry fiction) 13. Tazkiya Nafs ( Maktubat of Syed Shah Ashrafuddin Yahya Ahmed Muneeri, Nuzhatul Arwah, Mathnawi Molvi Manavi, Hadeeqa Hakim Sinai) 14. Planning 15. Goal setting 16. Operations Management 16. Politics 17. Health Maintenance 18. Mathematics 19. Religious Studies.

লক্ষ্য করার মতো ইতিহাস পাঠ্যসূচিতে জায়গা হচ্ছে তৈমুরের বিজয়কাহিনী, আকবরের আকবরনামা, জাহাঙ্গীরের স্মরণিকা এবং মহাভারত। লক্ষ্য করি, তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মশুদ্ধির সিলেবাসে বিভিন্ন বুজুর্গদের লেখনী ও মসনবি। লক্ষ্য করি, প্ল্যানিং বা প্রকৌশল বিদ্যা, অপারেশন ম্যানেজমেন্ট, রাজনীতি, স্বাস্থ্যরক্ষা এবং একেবারে শেষে চলে গিয়েছে ধর্মীয় পাঠ।


মাদ্রাসা ও অন্যান্য স্কুলগুলিতে আর্টস বা কলাবিদ্যার প্রশিক্ষণ চলছে, তরুণ সমাজ ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করছে, ধাতুবিদ্যা কাঠের কাজ, বয়ন শিল্প, এমব্রয়ডারি, চর্মশিল্প, কার্পেট তৈরি, হাতির দাঁতের তক্ষণকার্য ইত্যাদি। মুঘল কারিগরদের শৈলীগত দক্ষতা তাদের বিদ্যাচর্চার ও প্রশিক্ষণের একটা উচ্চমার্গে পৌঁছেছে বোঝা যায়। বোঝা যাচ্ছে, কেমন করে স্থাপত্যকলায় উন্নতি করেছিল মোঘল যুগের স্থপতিরা এবং কারিগর ও শিল্পী কুশলীরা। তাঁরা সেকেন্দ্রা, হুমায়ুন মকবরা, জুমা মসজিদ বা পৃথিবীর সপ্ত বিস্ময়ের অন্যতম তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ধর্মের প্রাধান্য পুনরায় বেড়ে যাচ্ছে। ধর্মশিক্ষার প্রাধান্য এবং ফিকা ও ফতোয়া চর্চা বেড়ে যাচ্ছে। চরিত্রনির্মাণ বিদ্যার জায়গায় এখন ফতোয়ার বিশ্বকোষ 'ফতোয়ায়ে আলমগীরী' পাঠ্য হয়ে উঠছে।


বাংলায় মাদ্রাসা:


ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী ১২০৪ গৌড়ের প্রথম মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। পরে গিয়াসউদ্দিন ১২১২ এবং দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন দুটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন এ দুটির নাম লাখনুতী মাদ্রাসা ও গৌড় মাদ্রাসা। তবে, মাহীসন্তোষে হযরত মাওলানা তকিউদ্দীন আল আরাবীর মাদ্রাসাকে বাংলার প্রাচীনতম মাদ্রাসা বলা হচ্ছে। ইখতিয়াউদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলা দখলের পর ত্রয়োদশ শতকের গোড়ায় আল আরাবী প্রতিষ্ঠিত এই মাদ্রাসাটি প্রাচীনতম।

মাওলানা আবু তাওয়ামা ১২৭৮ খ্রি. সোনারগাঁওয়ে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯) ও তাঁর পুত্র নুসরত শাহ আরো কিছু মাদ্রাসা স্থাপন করেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। (বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ; দ্র. মাদ্রাসা)


১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে সুবেদার শায়েস্তা খান বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায় একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। নবাব জাফর মোরশেদ আলি মুর্শিদাবাদে স্থাপন করেন মূর্শিদাবাদ মাদ্রাসা। ১১৭৮ হিজরীতে জমিদার মুন্সি সদরউদ্দিন আল মুসাভী বুহার গ্রামে বর্ধমান মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং লখনৌ থেকে আব্দুল আলি বাহারুল উলুমকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। এই মাদ্রাসাগুলির ব্যয়নির্বাহের জন্য নবাবী আমলে লাখেরাজ জমি বরাদ্দ করা হতো। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য সরকার ভাতা এবং বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিল। ( M.S Asimov, Clifford Edmund Bosworth (1999), The Age of Achievement, Vol. 4, Motilal Banarasidass, 33-34: ISBN 81-208-1596-3)


ইংরেজ শাসনকালে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি বিপদজনক অথচ নতুন মোড় নেয়। মাদ্রাসা গুলির নামে মুঘল সরকারের দ্বারা বরাদ্দকৃত লাখেরাজ জমি দ্রুতবেগে বাজেয়াপ্ত করা হয়। আঠারো শতকের শেষে ও উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। যদিও ১৭৮০ সালে কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপিত হয়। মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন বাংলার গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস।


কলকাতা তখন বাংলার রাজধানী। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করল ইংরেজি বণিকদল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তিন বছর যেতে না যেতেই দেখা দিল পৃথিবীর ভয়াবহতম মন্বন্তর। বাংলা সন হিসাবে ১১৭৬ মোতাবেক ১৭৬৯ সালে শুরু হল 'ছিয়াত্তরের মন্বন্তর'। এই মন্বন্তরের পটভূমিতে ফকির সন্ন্যাসীদের মিলিত বিদ্রোহ, মজনু শাহ-এর নেতৃত্বে, সহায়তা দিলেন ভবানী পাঠক ও অন্যান্য সন্ন্যাসীরা। কোম্পানির ত্রিশঙ্কু অবস্থা। দেশীয় নায়েব গোমস্তা তহশিলদার কালেক্টরদের অত্যাচারে সাধারণ প্রজাদের নাভিশ্বাস উঠে গেল। দ্বৈত শাসনের কালে কোম্পানি চোখ বুজে থাকল, প্রমাদ গণল কোম্পানি, তার আশঙ্কা হল বিপদের। মাত্র কবছর আগে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজউদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয় দেশবাসী ভুলতে পারেনা।


ওদিকে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এদিকে ভয়াবহ মন্বন্তর। অতএব, কোম্পানি তার আপন জ্বালা নিবারণের জন্য হেস্টিংস স্থাপন করলেন কলকাতা মাদ্রাসা ১৭৮০। উদ্দেশ্য -- ইসলামী আইন ও আরবি-ফারসি জানা কিছু কেরানিকুল তৈরি করা, যারা সাধারণ মানের কোন পদে বা কোর্টকাছারিতে কোম্পানির সহায়ক হিসেবে কাজ করতে পারবে। তারা ভাবল, এতে দেশের মুসলমান সমাজের কাছে তারা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। এই সেই প্র-তাড়না,, রাষ্ট্রের আপন পিঠে ছড়ির ঘা। কোথায় বাগদাদের 'বাইত আল হিকমাহ' আর কোথায় কলকাতা মাদ্রাসা?


ব্রিটিশ শাসনাধীনে ভারতের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত সর্বপ্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কলকাতা মাদ্রাসা। ১৭৮০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত করেন গভর্নর জেনারেল লর্ড হেস্টিংস। দেড় বছর যাবত এর সম্পূর্ণ দায়ভার নিজে বহন করেন, যদিও পরবর্তী সময়ে এর পুরোটাই তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়। ১৭৮০ সালের এপ্রিলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কলকাতা নগরীর শিয়ালদার কাছে বৌবাজার সন্নিহিত একটি বৈঠকখানায় স্থাপিত হলেও ১৮২৭ সালে এর বর্তমান অবস্থান হাজী মোহাম্মদ মহসিন স্কোয়ারে স্থানান্তরিত করা হয়। এর প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন ইসলামী শিক্ষায় বড় পণ্ডিত বাহারুল উলুম মোল্লা মাজদুদ্দিন। দারসে নিজামীর আদলে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করেন তিনি। হেস্টিংস এর নির্দেশিত পথে তিনি এই পাঠক্রমে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেন। বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দারসে নেজামীর আদলে শিক্ষাদান পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এই পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবি ও ফারসি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত ৯৯টি গ্রন্থের মধ্যে অন্তত একটি পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। অবশ্য ধর্মীয় পাঠক্রমেও অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনানী চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প, কারিগরি প্রশিক্ষণ। দরসে নিজামীর মোট শিক্ষাকাল ছিল ৯ বছর।


মাদ্রাসার ব্যাপারে প্রথম প্রত্যক্ষ আমলাতান্ত্রিক হস্তক্ষেপ ঘটে ১৭৯০ সালে। যখন অব্যবস্থাপনা ও ছাত্রদের উচ্ছৃঙ্খলতা ও ব্যাপক অভিযোগের পটভূমিতে ২৪ পরগনার কালেক্টর মাদ্রাসার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তদন্তের পর প্রধান শিক্ষককে ১৭৯১ সালে অপসারণ করা হয়। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মাওলানা মুহাম্মদ ইসমাইল। এবার প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার ভার রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি কমিটির উপর ন্যস্ত করা হয়। মাদ্রাসার প্রশাসনিক দক্ষতা বাড়াতে ১৮১৯ সালে একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সামরিক অফিসার ক্যাপ্টেন অ্যারনকে মাদ্রাসা ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম সচিব নিয়োগ করা হয়। ১৮৪২ সালে কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল। মাদ্রাসাটিকে নিরবচ্ছিন্ন অবনতির প্রবাহ থেকে উদ্ধার করতে ১৮৫০ সালে প্রথমবারের মতো একজন ইউরোপীয় ড. অ্যালয়েস স্প্রেঞ্জারকে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তাঁর পরে বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় অধ্যক্ষ নিয়োগ করা হয়েছিল এদের মধ্যে সর্বশেষ ছিলেন এ এইচ হার্লি, যিনি ১৯১০-১১ সালে অধ্যক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।


কলকাতা মাদ্রাসা শুরু থেকেই প্রখ্যাত আরবী স্কুল 'ফিরিঙ্গি মহলে'র দারসে নিজামীর মডেল অনুসরণ করে পাঠদানের কোর্স প্রণয়ন করে, আগেই বলেছি। ১৮৫০ সাল পর্যন্ত মাদ্রাসার পাঠক্রমে ফারসি ভাষা আরবির উপর শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে মুখ্য স্থান দখল করে। তখনকার দিনে বাংলা ভাষাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা হয়েছিল। সুলতানী আমলে ও মুঘল যুগে ফারসি ছিল রাজভাষা, তাই ঝোঁক ছিল ফারসির প্রতি। তবে সিলেবাসে ত্রৈরাশির দ্বৈত নিয়ম অর্থাৎ অনুপাত ও সমানুপাত পর্যন্ত গণিত শেখানো হতো এবং ইউক্লিডের একটি পাঠ পড়ানো হতো। মাদ্রাসার সিলেবাসে ইতিহাস, ভূগোল, এমনকি তাফসীর ও হাদিসেরও স্থান ছিল না। ছিল শুধু আইন (ফিকাহ), জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দজ্ঞান ও ধর্মতত্ত্ব। অ্যারিস্টটলের পুরাতন দার্শনিক চিন্তাধারার আদর্শের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন পড়ানো হতো। হয়তো তেমন গুরুত্ব সহকারে নয়।


১৮২৬ সালে প্রবর্তিত প্রাথমিক ইংরেজি কোর্সগুলির প্রবর্তন থেকে শুরু করে কিছু সংস্কার প্রচেষ্টা হয়েছিল বটে, তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। ১৮২৬ সাল থেকে ১৮৫১ সাল পর্যন্ত পঁচিশ বছরের অধিক সময় মাদ্রাসাটি শুধু দুজন নিম্নপদস্থ ইংরেজি শিক্ষিত পণ্ডিত -- নবাব আব্দুল লতিফ ও ওয়াহিদুন্নবী -- তৈরি করতে পেরেছে, একথা বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। ১৮৬৩ সালে কলকাতা মাদ্রাসায় এফ. এ. পর্যায়ের ক্লাস সংযোজিত হলে তাও দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হয়। এগুলি ১৮৬৯ সালে গিয়ে স্থগিত রাখা হয় এবং অবশেষে ১৮৮৮ সালে এই কোর্স পরিত্যাগ করা হয়েছিল। আরেকটি সংস্কার প্রচেষ্টা ছিল ১৮৫৪ সালে মাদ্রাসার মধ্যে একটি পৃথক ইনস্টিটিউট হিসেবে ইঙ্গ-ফারসি বিভাগ (Anglo-Persian Department) প্রতিষ্ঠা। এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নবাব আব্দুল লতিফের পরামর্শ ও উদ্যোগ এখানে সক্রিয় ছিল। তবে এখানে অভিজাত সম্প্রদায়ের মধ্যে ভর্তি সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে 'শরাফতনামা' (উচ্চবংশে জন্মের সনদপত্র)-র উপর জোর দেওয়া হতো। (একটু হেসে নিন, যেমন বাঙালির মাতৃভাষা কী -- এই প্রশ্নে আশরাফদের মাতৃভাষা উর্দু ও আতরাফদের বাংলা বলেছিলেন নবাব আব্দুল লতিফ, এই সময় এখানেও কি তাঁর অভিজাত হাত ছিল? না, ফাঁপা কৌলীন্য (!) বজায় রাখার চেষ্টা?) যাই হোক, মুসলিমদের মধ্যে এই অ্যাংলো-পার্সিয়ান ডিপার্টমেন্ট তেমন আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেনি বলে বলা হয়। তবে উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও জাতির জন্য কল্যাণকর। উচ্চ ইংরেজি স্কুলের ( High English School, HES, যেমন তুলনীয়, Middle English School, M.E. School) অনুরূপ মান বজায় রেখে এবং ফারসি ভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠিত ইঙ্গ-ফারসি বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার্থীদেরকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তোলা। ১৮২১ সালে মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রবল বিরোধিতার মুখে মাদ্রাসার আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা (formal examination) ব্যবস্থা চালু করা হয়। ১৮৫৪ সালের শিক্ষা সংক্রান্ত যে ডেস্প্যাচ', যা 'উডের ডেস্প্যাচ' নামে পরিচিত, তাতে কলকাতা মাদ্রাসাকে প্রস্তাবিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিয়ে আসার ইঙ্গিত থাকলেও কলকাতা মাদ্রাসাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা হয়নি।

কী করে হবে? থামুন একচোট হেসে নিই। দরজাই নেই, তায় আবার ছিটকিনি! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, তার অধীনে এই সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী মাদ্রাসাকে নিয়ে যাওয়া হবে! মনে করি, আগ্রাসী এই মানসিকতা। এই মনোভাব কার ছিল, জানা নেই‌, তবুও ওই প্রস্তাবের ১৬৬ (১৮৫৪-২০২১) বছর পর তীব্র নিন্দা করি।


ফলে কলকাতা মাদ্রাসা উপমহাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি বিচ্ছিন্ন ধারা হিসেবে গড়ে ওঠে। অথচ মনে রাখতে হবে, এই কলকাতা মাদ্রাসা ব্রিটিশ ভারতের সর্বপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।


একসময় সিলেবাসে থাকলো আইন (ফিকাহ), জ্যোতির্বিদ্যা, যুক্তিবিজ্ঞান, দর্শন, পাটিগণিত, জ্যামিতি, ছন্দোবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, এবং ধর্মতত্ত্ব। ১৮২৭ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক পি ব্রেটন মেডিকেল ক্লাস শুরু করে দেন এই মাদ্রাসায়। ১৮৩৬ সালে 'কলকাতা মেডিকেল কলেজ' স্থাপিত হওয়া পর্যন্ত মেডিকেলের ক্লাস এখানেই চলত। এই মাদ্রাসার ছাত্ররা সরাসরি কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তির সুযোগ পেত। ১৯২৭ সালে মাদ্রাসার শিক্ষাকাঠামোর নতুন বিন্যাস ঘটানো হয়। আলিম, ফাজিল, কামিল, মুমতাজুল মুহাদ্দেসিন।


মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার দুটি ভাগ : দারসে নিজামী বা কওমি মাদ্রাসা এবং হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা। যে মুষ্টিমেয় শিক্ষিত জন মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির চেষ্টা করেছিলেন, মুসলমান সমাজকে শিক্ষা ক্ষেত্রে মূল স্রোতে টেনে আনার চেষ্টা করছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিক্ষাবিদ শামসুল উলামা আবু নসর মোহাম্মদ ওয়াহিদ। তিনি ১৯১৪ সালে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ছবি প্রত্যক্ষ করে এসে যে রিপোর্ট পেশ করলেন, তাতে ধর্মশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার সংযোগ সাধন করার ব্যবস্থা থাকল। এই শিক্ষাধারার নাম হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা। এখানে মাধ্যমিক সিলেবাস এর সঙ্গে ধর্মীয় সিলেবাসের সংযোগ সাধন করা হলো। হাই মাদ্রাসা ব্যবস্থা থেকে যারা মাধ্যমিক স্তর পার হবে তারা সরাসরি কলেজ ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হতে পারবে। এই ব্যবস্থার অপর নাম নিউ স্কিম মাদ্রাসা। অবশ্য পুরনো পদ্ধতির নাম হয়ে গেল ওল্ড স্কিম।


আলিয়া মাদ্রাসা উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকার গঠিত শিক্ষা কমিশন কর্তৃক প্রণীত পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির অনুযায়ী আলিয়া মাদ্রাসায় পাঁচটি স্তর: ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর; মোট ১৬ বছরের কোর্স পরিচালিত হয়। কামিল স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তাফসীর হাদীস আরবি সাহিত্য এবং মুজাব্বিদ শাখায় দুই বছর মেয়াদী কোর্স শেষে ডিগ্রি প্রদান করা হয়।


কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পর হতে আলিয়া মাদ্রাসা সংস্কারের জন্য সরকার বিভিন্ন সময় কমিটি গঠন করে। আলিয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার প্রায় ১০ বছর পর ১৭৯১ সালের মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদ আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা কারিকুলাম সিলেবাস প্রবর্তন করে। এই সিলেবাস কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা অধিভুক্ত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সকল মাদ্রাসায় বাস্তবায়ন করা হয়। ১৮৬৯ সালের কমিটি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় কিছু সংশোধনী আনে। ১৮৭১ সালে বিচারপতি নরম্যান কমিটি বেঙ্গল মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে। ১৮৭০ সালে মহসীন ট্রাস্টের অর্থে ঢাকা মাদ্রাসা (বর্তমান সরকারি কবি নজরুল কলেজ), চট্টগ্রাম দারুল উলুম মোহসিনীয়া মাদ্রাসা (বর্তমানে সরকারি মোহসিন কলেজ), রাজশাহী মাদ্রাসা (বর্তমানে রাজশাহী সরকারি মাদ্রাসা) প্রতিষ্ঠিত হয়।


১৮৮২ সালের হান্টার কমিটির রিপোর্ট ১৮৮৪ সালে বাস্তবায়িত হয়। ১৯০৭ সালের কলকাতা কনফারেন্সে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় সমমানের তিন বছরের টাইটেল ক্লাস খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯১০ সালে এ. এইচ. হার্লির নেতৃত্বে গঠিত এডুকেশন অ্যাডভাইজরি কমিটি মাদ্রাসার শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করে।


১৯১৪ সালে অধ্যক্ষ শামসুল উলামা আবু নসর ওয়াহিদ এর নেতৃত্বে গঠিত মহামেডান এডুকেশন এ্যাডভাইজারী কমিটি কর্তৃক প্রণীত কারিকুলাম, আগেই বলেছি, ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয় এবং ১৯১৫ সালে তা বাস্তবে বাস্তবায়িত হয়। মুসলমানদের ইংরেজি শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার লক্ষ্যে জুনিয়র ও সিনিয়র নামে দু'ধরনের নিউ স্কিম মাদ্রাসা চালু হয়। জুনিয়র মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত, সিনিয়র মাদ্রাসার মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানো হতো। এসব সিনিয়র মাদ্রাসার পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষাকে বাধ্যতামূলক করে সরকারি সাহায্যভুক্ত করা হয়। সরকারি চাকরি পেতে মুসলিম শিক্ষার্থীরা নিউ স্কিম মাদ্রাসায় পড়তে বিশেষ আগ্রহী ছিল।


কিন্তু ১৯২১ সালে হাই মাদ্রাসা ও ইন্টারমিডিয়েট কোর্সের পরীক্ষা পরিচালনা করা ও সার্টিফিকেট দেবার জন্য গঠিত হয় Board of Intermediate and Secondary education.

স্বাধীনতা-পূর্ব কালে এইটিই প্রথম শিক্ষা পর্ষদ।

M.E বা Junior (class vi), Junior High (class viii) এবং High Madrasah (class X) স্থাপিত হতে থাকে।

বর্তমানে পশ্চিম বঙ্গে এই ব্যবস্থা চলছে।


শামসুল হুদা কমিটির ১৯২৭ সালে বাংলা অাসামের ওল্ড স্কিম সিনিয়র মাদ্রাসা গুলির আলিম ফাজিল ও ফাখরুল মুহাদ্দিসীন শ্রেণীর কেন্দ্রীয় পরীক্ষা মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক গ্রহণ করার প্রস্তাব করে। এই কমিটি প্রণীত কামিলের সিলেবাসে সিহাহ সিত্তা (বুখারী মুসলিম তিরমিজি ইবনে মাযা আবু দাউদ) প্রভৃতি হাদিস, তাফসিরুল হাদিস, তাফসিরুল কোরআন, তাফসিরুল কাশশাফ, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ে অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করা হয়।


১৯২৭ সালে Mohammedan Education এর Assistant Director of Public Instruction কে চেয়ারম্যান এবং কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে রেজিষ্ট্রার করে Board of Central

Madrasah Examination, Bengal নামে সর্বপ্রথম একটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড গঠিত হয় তখনও স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ গঠিত হয়নি।

দেশভাগের পরে আলিয়া মাদ্রাসা ঢাকা স্থানান্তরিত হল কলকাতা মাদ্রাসার ক্ষেত্রে এক স্বাধীন ভারতের শিক্ষা মন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদ হাজার 948 সালে কলকাতা মাদ্রাসা কে স্বাধীন ভারতে এবং এই মাদ্রাসার স্থান হয় তখন হুগলি মাদ্রাসা মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ভারতের শিক্ষা কাঠামো নির্মাণের জন্য এবং বিশ্বের দরবারে ভারত সংস্কৃতি ও ভারতীয় শিক্ষার গৌরব ঐতিহ্য কে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে শেয়ার গঠন করেছেন আর ভারতের স্থাপন করেছেন নানান রকমের শিক্ষা কমিশন রাধাকৃষ্ণন কমিশন মুদালিয়ার কমিশন কোঠারি কমিশন বিদ্যালয় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন কমিশন গঠিত হয়েছে কখনো মাওলানা আকরাম খাঁ কখনো ডঃ কুদরত এ খোদা ইত্যাদি কে সামনে রেখে।


১৯৭৮ সালে প্রফেসর মুস্তফা বিন কাসিমের নেতৃত্বে Senior Madrasah Education System Committee গঠিত হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ জুন হতে বোর্ডটি একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জনশিক্ষা পরিচালক প্রফেসর বাকিবিল্লা খান এর প্রথম চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন।


১৯৮৪ সালে মুস্তফা বিন কাসিমের কমিটির সুপারিশের আলোকে সাধারণ শিক্ষার স্তরের সঙ্গে মাদ্রাসা বোর্ড নিয়ন্ত্রিত আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা স্তরে নিম্নরূপ সামঞ্জস্য করা হয়: ইবতেদায়ী (প্রাথমিক) ৫ বছর, দাখিল (মাধ্যমিক) ৫ বছর, আলিম (উচ্চমাধ্যমিক) ২ বছর, ফাযিল (ডিগ্রি) ২ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর; মোট ১৬ বছরের কোর্স পরিচালিত হয়। এই কমিটি কর্তৃক প্রণীত সিলেবাস ১৯৮৫ সালে অনুষ্ঠিত দাখিল ও ১৯৮৭ সালে অনুষ্ঠিত আলিম পরীক্ষায় কার্যকর হয়। উক্ত দুই শ্রেণীতে মাদ্রাসার নির্ধারিত সকল পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও সাধারণ শিক্ষার যথাক্রমে এসএসসি এবং এইচএসসি সম্পূর্ণ কোর্স অন্তর্ভুক্ত করে দাখিলকে এসএসসি এবং আলিমকে এইচএসসির সমমান দেওয়া হয়। সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা এখন মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে উচ্চতর শিক্ষার জন্য অনুমোদিত যেকোনো কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু ফাযিল (ডিগ্রী) এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সমন্বিত না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা শুধু মাদ্রাসা বা স্কুলের চাকরির ক্ষেত্রে সমমান পায়, অন্য ক্ষেত্রে নয়।


২০০৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত মাদ্রাসা বোর্ড আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষার ইবতেদায়ী বা প্রাথমিক হতে কামিল বা স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সকল স্তরের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত। বর্তমানে Islamic University (Amendment) act, 2006 মোতাবেক সাধারণ শিক্ষার সাথে আলিয়া মাদ্রাসা শিক্ষা সমন্বিত করার কারণে ফাযিল (ডিগ্রী) ৩ বছর এবং কামিল (স্নাতকোত্তর) ২ বছর মোট পাঁচ বছরের কোর্স চালু হয়েছে। তাই সিদ্ধান্ত হয় যে, ২০০৬ 2006 সালের পর থেকে মাদ্রাসা বোর্ড শুধু দাখিল ও আলিম পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। উক্ত আইন অনুসারে ২০৮৬টি ফাযিল (স্নাতক) এবং ১৯৮টি কামিল (স্নাতকোত্তর) মাদ্রাসা অর্থাৎ ১২৮৪টি মাদ্রাসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত হয়। এতে সাধারণ শিক্ষার সাথে মাদ্রাসা শিক্ষার দীর্ঘদিনের বিরাজমান পার্থক্য দূরীভূত হয়।

বর্তমানে বহু মাদ্রাসা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উন্নীত হয়েছে এবং প্রায় সকল স্কুল ও মাদ্রাসায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ছে। এসবই সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থার সুস্থতার লক্ষণ।


তাই, একথা বলা আবশ্যক যে, অনেক সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও কলকাতা মাদ্রাসা কার্যত একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল, যা প্রায় এক শতাব্দীকাল, এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরও, প্রশংসনীয় সংখ্যক মুসলিম ছাত্রদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল।


এখান থেকে বেরিয়েছেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ডঃ কুদরত-এ-খোদা, নবাব আব্দুল লতিফ, জনাব ওয়াহিদুন্নবি প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ।


উপনিষদের শ্লোকাংশ উচ্চারণ করি -- "পুষন আপাবৃণু" -- হে সূর্য, আবরণ উন্মোচন কর, সত্য উদ্ভাসিত হোক। আলোকিত হোক জগত সংসার। বলি -- "নূরুন আলা নূর" -- জ্যোতিই জ্যোতি।

 
 
 

Comments


Subscribe to Site

Thanks for submitting!

© 2020 Bhaan Theatre | Designed by Capturegraphics.in
bottom of page