কালপুরুষ
- Bhaan Magazine
- Sep 11, 2021
- 7 min read

ড. শর্মিলা ঘোষ
সহযোগী অধ্যাপক,
বাংলা বিভাগ,
শ্রী শিক্ষায়তন কলেজ
ছাত্রাবস্থায় বিদ্যালয়ের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কখনই পূর্ণতা পায়নি। শিক্ষকদের স্নেহ ও উদারতা, বন্ধুদের সহৃদয় সাহচর্য অথবা বিদ্যালয়ের পরিবেশ কোনটিই অনুকূল হয়ে ওঠেনি তাঁর কাছে। জীবনস্মৃতি ও ছেলেবেলা গ্রন্থের বিভিন্ন অংশে এর উল্লেখ স্পষ্ট। তাই তো শহরের স্কুলকে দশটা-পাঁচটার আন্দামান বলতেও দ্বিধা করেন না তিনি।
ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল আকাদেমি এবং সেন্ট জেভিয়ার্স- ছেলেবেলায় এই চারটি স্কুলে ভর্তি হলেও কোথাও একাত্মতা বোধ করেননি রবীন্দ্রনাথ।প্রতিটি ক্ষেত্রেই পঠন-পাঠন সম্পূর্ণ না করেই বিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। তাই অভিভাবকদের বারংবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ যে একজন 'স্কুলছুট' বা 'ড্রপ আউট' সেকথা বলা বোধ করি অন্যায় হবে না। আসলে প্রথাগত শিক্ষা তাঁকে বিমুখ করেছে বিদ্যালয়ের প্রতি। আর সে কারণেই "কোন বিদ্যালয়ের বন্ধনে, কোন ধারাবাহিক বিদ্যাচর্চার নিয়মশৃঙ্খলে তাঁহাকে বাধা যায় নাই।"(রবীন্দ্র জীবনী- প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়)।অথচ প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তিনি ভেবেছেন আজীবন। তাঁর জীবনদর্শনে, কর্মজীবনে এবং সাহিত্যিক প্রকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা চিন্তা একটা বড় জায়গা অধিকার করেছে। আর শিক্ষা বিষয়ক এই ভাবনা ক্রমে ক্রমে এতটাই গভীর হয়ে উঠেছে যে জীবনের মধ্যভাগে তিনি একটি ব্রহ্মচর্যাশ্রম শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। ৮০ বছরের ব্যাপ্ত জীবনের ঠিক চল্লিশতম বর্ষে(১৯০১) শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় স্থাপনে এক আশ্চর্য সমাপতন সন্দেহ নেই।
১৯০১ সালের ২২ ডিসেম্বর শান্তিনিকেতনে এক ব্রহ্ম উপাসনা মন্দিরকে কেন্দ্র করে স্থাপিত এই ব্রহ্মচর্যাশ্রম রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনার একটি দিক্ নির্দেশিকা বা মাইল ফলক সন্দেহ নেই। শিক্ষাদানের প্রচলিত পদ্ধতি রবীন্দ্রনাথকে বিমুখ করেছিল। তিনি চেয়েছিলেন উন্মুক্ত আকাশের নিচে, প্রকৃতির সাহচর্যে, সবুজ গাছপালার মাঝে শিশুরা তাদের বিদ্যালয় জীবন শুরু করুক। এই বিদ্যালয়ে তেমনটাই তিনি করেছিলেন। তিনি জানতেন এই কাজে আনন্দময় পরিবেশের সঙ্গেই প্রয়োজন উপযুক্ত শিক্ষক। এই সময় চিঠিতে লিখেছেন-"শান্তিনিকেতনে একটা নির্জন অধ্যাপনের ব্যবস্থা করিবার চেষ্টায় আছি। দুই একজন ত্যাগ-স্বীকারী ব্রহ্মচারী অধ্যাপকের সন্ধানে ফিরিতেছি।"(জগদীশচন্দ্র বসুকে লেখাপত্র, চিঠিপত্র ৬)। শুধু তাই নয়, পরবর্তী সময়েও দেশ-বিদেশের থেকে উপযুক্ত শিক্ষকদের তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছেন শান্তিনিকেতনে। পরবর্তী কালে লিখেছেন,"আশ্রমে যারা শিক্ষক হবে তারা মুখ্যত হবে সাধক।" এবং "আত্মদানের অকাপর্ণ্য যথার্থ শিক্ষকের যথার্থ পরিচয়।"(আশ্রমের রূপ ও বিকাশ)।
সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থার বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা একদিকে যেমন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি বিভিন্ন সাহিত্যের মধ্যে পরোক্ষভাবে এর প্রকাশ ঘটেছে। বলা বাহুল্য নাটকেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী, হাস্যকৌতুক প্রমুখ রচনায় প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক-ছাত্র প্রসঙ্গ রয়েছে।
রবীন্দ্র শিক্ষাভাবনায় এক দলিল স্বরূপ অচলায়তন(১৯১২) নাটক। জীবনের প্রাণস্পন্দন যেখানে নেই, সেই শিক্ষা অচল-কঠোর শৃঙ্খলা,আর সংকীর্ণতায় ভরপুর সেই প্রতিষ্ঠান 'অচলায়তন' হয়ে ওঠে। পঞ্চক এই কূপমন্ডুকতাকে,এই জড়ত্বকে স্বীকার করে নি। জীবনের সাধারণ স্বাভাবিক ছন্দকে উপভোগ করতে চেয়েছিল সে। আর তাই তাকে নিয়ে সকলের বিড়ম্বনা। এই আয়তনে অন্য সকল ছাত্রের শিক্ষা যখন 'ধ্বজাগ্রকেয়ূরী' মন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছে গেছে তখন পঞ্চক একেবারে শুরুর পর্বের "ওঁ তট তট তোতয় তোতয়" তেই আটকে আছে। চক্রেশমন্ত্র, মরীচি, মহামরীচি, পর্নশবরী, শৃঙ্গভেরিব্রত, কাকচঞ্চু পরীক্ষা, ছাগলোমশোধন এগুলির কোনটাই জানা নেই তার। আয়তনের জনৈক ছাত্ৰ যখন বলে যে এগুলো তো অন্তত জানা চাই, "নইলে তুমি অচলায়তনের ছাত্র বলে লোকসমাজে পরিচয় দেবে কোন্ লজ্জায়?"- তখন বোঝা যায় প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কোন গভীরে আঘাত করতে চান রবীন্দ্রনাথ। অচলায়তনের অন্যান্য ছাত্রদের নিয়ে কোন সমস্যা নেই। চিরাচরিতকে মেনে নেওয়াই তাদের ধর্ম। অভ্যাস পালনে কোন দ্বিধা নেই তাদের। এভাবেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করতে সক্ষম হয় তারা। সংশয়াতুর কোন প্রশ্ন পঞ্চকের মতো, তাড়িত করে না তাদের।
রবীন্দ্রনাথ এই অচলায়তনের মূল ভিতটাকে নাড়িয়ে দিতে চান আর সে কারণেই বুঝি শুধু পঞ্চকের মনে নয়, আচার্য অদীনপুণ্যের মনেও জমা হয় সংশয়; জড়ো হয় দ্বিধা। তাই গুরু আসছেন একথা জানার পর আচার্য উপাচার্যকে বলেন- "...প্রথম যখন এখানে সাধনা আরম্ভ করেছিলুম তখন নবীন বয়স,তখন আশা ছিল সাধনার শেষে একটা কিছু পাওয়া যাবে। ...তারপরে সেই সাধনার চক্রে ঘুরতে ঘুরতে একেবারেই ভুলে বসেছিলুম যে সিদ্ধি বলে কিছু একটা আছে। ...কিন্তু আজ দেখছি-এই অতিদীর্ঘকালের সাধনা কেবল আপনাকেই আপনি প্রদক্ষিণ করছে- কেবল প্রতিদিনের অন্তহীন পুনরাবৃত্তি রাশীকৃত হয়ে জমে উঠেছে।"
আচার্য পঞ্চককে দেখে বুঝতে পারেন মানুষের মন মন্ত্রের চেয়ে সত্য,হাজার বছরের অতি প্রাচীন আচারের চেয়েও সত্য। পঞ্চকের মধ্যে মুক্তিকে দেখতে পান আচার্য আর পঞ্চক তার মুক্তি খুঁজে পায় তথাকথিত ম্লেচ্ছ,অস্পৃশ্য শোণপাংশু আর দর্ভকদের মাঝখানে।
এ নাটকে তাই শেষ পর্যন্ত অচলায়তনের গুরু, শোণপাংশুদের দাদাঠাকুর আর দর্ভকদের গোঁসাই এক হয়ে যান। গুরুই ভেঙে দেন অচলায়তনের সু-উচ্চ প্রাচীর। সুভদ্র আর পঞ্চক অচলায়তনের উত্তর দক্ষিণ পূব পশ্চিমের সব বন্ধ দরজা জানলাগুলো খুলে খুলে বেড়ানোর ভার নিয়েছে। এই খোলা দরজা জানলা দিয়েই আসবে আলো বাতাস। আর ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া অচলায়তনের প্রাচীরের খোলা পথ দিয়ে সেখানে প্রবেশ করবে শোণপাংশু আর দর্ভকরা।
উচ্চ-নিচের তথাকথিত ব্যবধান ব্যতিরেকে মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের এই ভাবনা যেমন রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন নাটকে বা সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে, তেমনি জীবনচর্যায় এর প্রকাশ ঘটেছে। শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় স্থাপনের ক্ষেত্রেও এই মিলনের কথা বলেছেন তিনি,- "প্রথমে ছেলেদের এখানে এনেছিলাম যে বিশ্ব-প্রকৃতির উদার ক্ষেত্রে আমি এদের মুক্তি দেব কিন্তু ক্রমশ আমার মনে হল মানুষে মানুষে যে ভীষণ ব্যবধান আছে তা অপসারিত করে সর্বমানবের বিরাট লোকে মুক্তি দিতে হবে।" মানুষে মানুষের ব্যবধান দূর করার কথাই যেন অচলায়তন নাটকের শেষে রূপ পেয়েছে।
'মুক্তধারা'(১৯২২) নাটকে এক গুরুমশায় ও তাঁর ছাত্রদের কথা আছে। উত্তরকূটের এই গুরু স্বভাবতই রাজভক্ত। প্রশ্নহীন তাঁর আনুগত্য। তিনি চান ভবিষ্যতের এই নাগরিকরা রাজা রণজিৎ তথা উত্তরকূটের গৌরবে গৌরবান্বিত হতে শিখুক। উত্তরকূটের এই ছাত্রদের মনে শিবতরাইয়ের প্রতি চরম ঘৃণা আর উপেক্ষার বীজ সচেতন ভাবে বপন করেন এই 'গুরু'। অল্প সময়ের জন্য নাটকে তাদের অবস্থান হলেও গুরুত্ব অপরিসীম। প্রচলিত শিক্ষা যে কত অন্তঃসারশূন্য তার প্রমাণ এই অংশটি। প্রমথনাথ বিশী লিখেছেন-" Totalitarian রাষ্ট্রের হাতে পড়িলে শিক্ষা, দীক্ষা, সংষ্কৃতি সব কেমন করিয়া রাষ্ট্রনীতির অনুকূল হইয়া গড়িয়া ওঠে,গুরুমশায় ও বালকগণ তাহার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। গুরুমশায় চমৎকার একটি type. তাঁহার দোসর আধুনিক ইউরোপের কোন কোন রাষ্ট্রে সংখ্যায় প্রচুর।" আমাদের মনে হয় বর্তমান ভারতবর্ষেও তার সংখ্যা কম নয়।
তবে প্রত্যক্ষভাবে গুরু ও ছাত্রদলের কথা নাটকে এলেও, রবীন্দ্র ভাবনায় 'শিক্ষক' শব্দটির অথবা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের প্রকৃত যে বয়ান তার প্রকাশ ঘটেছে অভিজিৎ এবং ধনঞ্জয় বৈরাগীর চরিত্রে। ধনঞ্জয় বৈরাগী মুক্তধারা নাটকে শিবতরাইয়ের প্রজাদের পুরোধা। প্রজারা নিশ্চিন্তে নির্ভর করে তাঁকে। কিন্তু তিনি এটা চান না। তিনি চান শিবতরাইয়ের প্রজাদের ভেতরের মানুষটাকে জাগিয়ে তুলতে। না মার দিয়ে মারকে অতিক্রম করার মন্ত্র তিনি শেখাতে চান প্রজাদের। তাঁর প্রতি প্রজাদের পরম নির্ভরতা দেখেও তিনি বলেন-"ভালোবেসে তোদের চেপে মারার চেয়ে ভালোবেসে তোদের ছেড়ে থাকাই ভালো।" রাজা রনজিৎকে বৈরাগী বলেন-"ওদের যতই মাতিয়ে তুলেছি ততই পাকিয়ে তোলা হয়নি আর কি।" আমার বারবারই মনে হয়েছে এগুলো আসলে একজন প্রকৃত শিক্ষকের কথা। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ধনঞ্জয় বৈরাগী "মারখানেওয়ালার ভিতরকার মানুষ।" তিনি মারকে ছাড়িয়ে উঠে জয়ী হতে চান না মার দিয়ে মার কে অতিক্রম করতে চান। আর সেই শিক্ষাই যেন ছড়িয়ে দিতে চান তিনি শিবতরাইবাসীর মধ্যে। সমস্ত নাটক জুড়েই গানে-কথায় বৈরাগীর এ হেন শিক্ষক-সুলভ উপস্থিতি।
অপর চরিত্রটি অভিজিৎ। ব্যক্তিগত স্তরে রাজকুমার সঞ্জয়ের কাছে অথবা সমষ্টিগত দিক থেকে শিবতরাই বাসীর কাছে অভিজিতের বক্তব্য অবশ্যই শিক্ষণীয়। সঞ্জয়, অভিজিৎ অনুগামী। কিন্তু অভিজিৎ অনুগমনকে প্রশ্রয় দিতে চান না। সঞ্জয় অভিজিতের সঙ্গী হতে চাইলে অভিজিৎ জানিয়েছিল যে প্রত্যেককেই নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে বের করতে হয়। তা না করে "আমার পিছনে যদি চল তা হলে আমিই তোমার পথকে আড়াল করব।" রবীন্দ্র মানসে একজন আদর্শ শিক্ষকের বয়ান বুঝি এরকমই হবার কথা।
রক্তকরবী(১৯২৪) নাটকে আমরা এক অধ্যাপকের সাক্ষাৎ পাই। এই অধ্যাপক নাটকে তার পেশাগত পরিচয়ে পরিচিত। বস্তুতত্ববিদ্যা বা materialism -এর চর্চা করেন। তিনি এই পরিবেশ পছন্দ করেন না। নিজের অবস্থান সম্পর্কে তিনি অতৃপ্ত, অখুশি। অধ্যাপক রাজার মতোই নিজেকেও জালের আড়ালে বন্দী হয়ে বলে মনে করেন। নন্দিনীর প্রতি অধ্যাপক আকর্ষণ বোধ করেন তার কারণ "নন্দিনীকে সে তার বস্তুগত দিক দিয়ে বুঝতে পারে না। এমন কি নন্দিনীর 'রক্তকরবী'র আভরণকেও বস্তুগত দিক থেকে বোঝার চেষ্টা করে অধ্যাপক।"(সৌমিত্র বসু, রক্তকরবী : অন্য ভাবনায়) এভাবেই চরিত্রটিকে গড়ে তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় আদর্শ শিক্ষকের প্রতিনিধি এই অধ্যাপক নন।
'হাস্যকৌতুক' শীর্ষক কৌতুক নাট্যের 'ছাত্রের পরীক্ষা' রচনাটিতে লঘু সুরে শ্রীযুক্ত কালাচাঁদ মাস্টার ও ছাত্র শ্রী মধুসূদনের কথা বলেছেন রবীন্দ্রনাথ। শিক্ষককে তাড়ানোর জন্যে ছাত্রের প্রচেষ্টা, সব বিষয়ে ভুল উত্তর দেওয়া এবং শেষপর্যন্ত কার্যসিদ্ধির বিষয়।
প্রত্যক্ষভাবে শিক্ষক-ছাত্ৰ সম্পর্কের বাইরেও রবীন্দ্রনাথের নাটকে বেশ কয়েকটি শিক্ষক প্রতিম চরিত্র রয়েছে। নাটকের অন্যান্য চরিত্র অথবা পাঠকদের কাছে এঁদের ক্রিয়াকলাপ, সংলাপ এবং সিদ্ধান্ত শিক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। এমনই একটি চরিত্র 'ঠাকুরদাদা'। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকে এঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। 'শারদোৎসব' নাটকেই প্রথম ঠাকুরদাদা চরিত্রের প্রকাশ। পরবর্তী সময়ে 'রাজা' নাটকে ঠাকুরদা, 'অচলায়তন'-এ দাদাঠাকুর অথবা 'ডাকঘর'-এ ঠাকুরদা রবীন্দ্র ভাবনার প্রকাশে বিশিষ্ট হয়ে উঠেছে।
'রাজা' নাটকে ঠাকুরদা বলেছিল যে "রাজা আমাদের সবাইকেই রাজা করে দিয়েছে।...আমাদের রাজা নিজে জায়গা জোড়ে না, সবাইকে জায়গা ছেড়ে দেয়।" আর এই কথার অনুষঙ্গেই ছিল ঠাকুরদা-র গান- "আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে।" বৃহত্তর অর্থে এ কি এক সামাজিক-রাজনৈতিক শিক্ষা নয়? আর 'ডাকঘর' নাটকে ঠাকুরদা অমলকে বিশ্বাসের এক মনোভূমিতে পৌঁছে দিয়েছিল। "চুপ করো, অবিশ্বাসী, কথা কয়ো না"- নাটকে ঠাকুরদার এই শেষ সংলাপ এক অসামান্য কথন তৈরি করে। আমার মনে হয় ঠাকুরদার এই সংলাপে ভর করেই বুঝি এরপরে সুধা আসে। অমলকে যে সে ভোলেনি সেই আশ্চর্য কথাটুকু তাকে জানিয়ে দিতে।
এভাবেই রবীন্দ্র নাটকে রাজা, সন্ন্যাসী, বাউল অথবা কবি চরিত্রকে ব্যাখ্যা করা যায়। 'শারদোৎসব' নাটকে রাজা বিজয়াদিত্য সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশ ধারণ করে বলেছিলেন- "রাজা হতে গেলে সন্ন্যাসী হওয়া চাই।" বস্তুত এই চরিত্ররা এমন কিছু কথা বলেন, কোন সংকটময় মুহূর্তে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেন যেন এক মহত্তর বৃহত্তর সমাধানের পথ উন্মুক্ত হয়ে যায়। তাঁরা সংকীর্ণতাকে ভাঙেন, পথ দেখান, রুদ্ধ দ্বার উন্মুক্ত করেন এবং সর্বোপরি নতুন করে ভাবতে শেখান। বৃহত্তর অর্থে এ কি শিক্ষকেরই কাজ নয় ?
'বসন্ত','ঋণশোধ' প্রমুখ নাটকে কবি বলেছিলেন রাজার প্রকৃত সংজ্ঞা, বুঝিয়েছিলেন রাজকার্য কথাটির প্রকৃত অর্থ। আর 'রথের রশি' নাটকে কবির অমোঘ বক্তব্য মহাকালের রথ তথা মানবসভ্যতার ইতিহাসের অচল রথ সচল করে তুলতে পারে এতদিন ধরে শোষিত, নিপীড়িত শূদ্ররাই, এই সমাজ রাজনৈতিক ভাবনাও কি বৃহত্তর অর্থে সর্বজনীন এক শিক্ষা চিন্তা নয় ?
এই আলোচনায় আমাদের মনে পড়ে রাজা নাটকের সুরঙ্গমার কথা, দাসী সুরঙ্গমা, সুদর্শনাকে বলেছিল যে রাজা সুন্দর নয়। আর সুন্দর নয় বলেই এমন অদ্ভুত, এমন আশ্চর্য। "তুমি দেখব দেখব করে যে অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে রয়েছ সেইজন্যে কেবল দেখবার দিকেই তোমার সমস্ত মন পড়ে রয়েছে। সেইটে যখন ছেড়ে দেবে তখন সব আপনি সহজ হয়ে যাবে।" এই সত্য মনের গভীরে গ্রথিত হয়েছিল বলেই তো বাইরের সৌন্দর্যে রাজাকে খুঁজতে চাওয়া সুদর্শনা একদিন বহু দুঃখ কষ্টের তপস্যা পেরিয়ে রাজাকে বলতে পেরেছিল- "তোমাকে তেমন করে দেখবার তৃষ্ণা আমার একেবারে ঘুচে গেছে। তুমি সুন্দর নও প্রভু, সুন্দর নও, তুমি অনুপম।" বাহ্যিক সৌন্দর্য পেরিয়ে রূপাতীতে পৌঁছানোর এই শিক্ষা বোধকরি সুদর্শনা প্রথম পেয়েছিল সুরঙ্গমার কাছ থেকেই।
'বিসর্জন' নাটকে প্রবল প্রতাপান্বিত রাজা গোবিন্দমাণিক্য এবং রাজপুরোহিত রঘুপতি উভয়েই দিশা খুঁজে পেয়েছিলেন অপর্ণার কাছে। অপর্ণার ছাগশিশুর হত্যার রক্তচিহ্ন মন্দিরের সোপান গাত্রে দেখে এবং অপর্ণার কাতর প্রশ্নে গোবিন্দমাণিক্য তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মন্দিরে বলি বন্ধ করার। কোন প্রতিকূলতাই তাকে টলাতে পারেনি এই সিদ্ধান্ত থেকে। আর নাটকের শেষে, জয়সিংহের আত্মহননের পরে নিঃস্ব, রিক্ত সর্বহারা রঘুপতি শেষ আশ্রয় পেয়েছিলেন অপর্ণার কাছে। মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এসে অপর্ণার মধ্যে তিনি দেখেছিলেন প্রত্যক্ষ প্রতিমাকে। দেখেছিলেন প্রকৃত জননীকে। ভিখারিণী অপর্ণার পথই তাই এই নাটকের শেষ গন্তব্য হয়ে উঠেছে।
এইভাবেই শিক্ষা সম্বন্ধীয় রবীন্দ্রভাবনার নানা অনুষঙ্গ ছড়িয়ে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকে। এই সব সূত্রকে একসাথে করলে হয়তো আদর্শ এক শিক্ষকের রূপরেখা অথবা শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক আমাদের কাছে পূর্ণতা পাবে।
Comments