উৎপল দত্তের সুবিখ্যাত " চায়ের ধোঁয়া' র জাত চেনালেন - সুমন দে।
- Avijit Mitra
- Jul 8, 2021
- 4 min read
Updated: Jul 10, 2021

লেখক : সুমন দে
সাহিত্যিকেরা fictional চরিত্রের সঙ্গে কারবার করতে করতে যখন হাঁপিয়ে
ওঠেন তখন সেই কল্পিত পরিস্থিতির বাইরে বেরিয়ে তাদের মনের দুর্দমনীয়
স্বীকারোক্তিগুলিকে প্রকাশ করতে তারা তৎপর হন। ";নিরব সাহিত্য কখনোই
সাহিত্য-পদবাচ্য হতে পারে না"; - এই কথায় বিশ্বাসী সাহিত্যিকেরা তাদের হৃদয়ে
লুকিয়ে থাকা সাহিত্যচেতনাগুলিকে কখনোই পর্দার আড়ালে রাখতে পারেননি। এটা
তাদের মজ্জাগত অভ্যেস। কিন্তু সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বিষয় হল এই
স্বীকারোক্তিগুলিকে তারা কীভাবে পাঠকমহলে প্রস্তুত করছেন। আমরা বঙ্কিমচন্দ্রের
মত প্রাতঃস্মরণীয় উপন্যাসিককে দেখেছি উপন্যাস ছেড়ে নিজের কথা সরাসরি
প্রবন্ধের মাধ্যমে বলতে। তেমনই তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়-
সহ প্রথম সারির সাহিত্যিকেরা অনুরূপ কাজ করেছেন। নাটককার উৎপল দত্তও
নাটকের চেনামহল থেকে বেরিয়ে এসে গদ্যের সাহায্য নিলেন। তাঁর বেশ কয়েকটি
গদ্য-সংকলনের মধ্যে অন্যতম হল ";চায়ের ধোঁয়া";। এই গদ্য-সংকলনটি ভিন্নস্বাদে
প্রস্তুত করা হয়েছে। তাঁর একাধিক সত্তাগুলিকে তিনি বাঁধলেন একেকটি চরিত্রে এবং
আড্ডার মাধ্যমে তাদের একটি ফ্রেমে এনে হাজির করলেন। এই গদ্য-সংকলনের
সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ";পঞ্চভূত"; প্রবন্ধ-সংকলনের মিল পাওয়া যায়, যেখানে
এমনই এক আড্ডার পরিবেশ সৃষ্টি করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সত্তাগুলিকে স্বতন্ত্র আদর্শ
ও যুক্তির মাধ্যমে বেঁধে শিল্পিত প্রকাশ ঘটালেন।

আসলে রবীন্দ্রনাথ ও উৎপল দত্ত দুজনেই বাঙ্গালীর আড্ডা-সংস্কৃতির সঙ্গে
পরিচিত ছিলেন। বাঙালির এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যকে তাঁরা তুলে ধরলেন লেখায় এবং
তাদের মনের nonfictional কথাগুলিকে fictional রূপ দিলেন। এই প্রসঙ্গে সত্যজিৎ
রায়ের “আগন্তুক” চলচ্চিত্রের একটি বিশেষ দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায় যেখানে
রবি ঘোষ ও আগন্তুক-রুপি উৎপল দত্তের মধ্যে বাঙালির আড্ডা-সংস্কৃতি নিয়ে
কিছু চমৎকার কথোপকথন আমরা পাই। সেখানে উৎপল দত্ত বাঙালির আড্ডায়
পরনিন্দা-পরচর্চার বাহুল্য দেখে আড়াই হাজার বছর আগের গ্রীসের আখড়ার প্রসঙ্গ
তুলে আনেন। সেখানে শরীর চর্চার পাশাপাশি মনের চর্চাকেও প্রধান্য দেওয়া হতো।
এই concept-টিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জুভেনাইল বলেছেন- ";Mens sana in
corpore sano."; অর্থাৎ sound mind in a sound body। এথেন্সের শ্রেষ্ঠ
জ্ঞানীগুণীরা সেই আখড়ায় যোগ দিতেন এবং দর্শন, সাহিত্য, রাজনীতি, গণিত
ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক হত। আমরা ";Republic"; কিংবা
";Poetics"; ঘাটলে যেরকম 'dialogue' লক্ষ করি তা আসলে ওই আখড়ারই
অনুকরণে লেখা। অর্থাৎ পরনিন্দা-পরচর্চা নয়, সেই আড্ডা হতো 'highest level of
mind'- এর পর্যায়ে। উৎপলবাবু এটিকেই পাথেয় করে বাঙালিত্বের ছাঁচে ফেলে তার
মনের অন্তঃস্থলে লুকিয়ে থাকা থিয়েটারের উন্নতিকরণের পন্থাগুলিকে বাইরে এনেছেন
এবং সেইসঙ্গে উঠে এসেছে রাজনীতি, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলা। এককথায়
চায়ের ধোঁয়া গদ্য-সংকলনটিকে ‘রঁদেভু’-এর বাঙালি সংস্করণ বলা যায়।
সমাজের অবক্ষয়গুলি যে ধ্বংসস্তুপ তৈরি করেছিল, সেই ধ্বংসাবশেষ থেকে
ফিনিক্সের সন্ধান করেছে উৎপল দত্তের নাট্য-সম্ভারগুলি। তাঁর নাট্য-মানসসম্পর্কে
তিনি বলেছেন -"; what the theatre means to me for the last forty years, it
has meant a weapon of political propaganda."; - এই 'political propaganda'
কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উজ্জ্বলতা দান করে না, বরং তারা শোষিত শ্রেণীর মুক্তির
তরে গণঅভ্যুত্থানকে অধিকমাত্রায় প্রতীকায়িত করে, যা তৎকালীন রাজনৈতিক
থিয়েটারের অনিবার্য প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। আর এই কর্মযজ্ঞের
শরিক হয়েছিলেন উৎপল দত্ত। ";চায়ের ধোঁয়া"; গদ্য-সংকলনে একটি বিশেষ
সময়ের কথা উঠে আসে, যখন প্রগতিশীল বামমনস্ক নাটককারেরা গণনাট্য সংঘের
আশ্রয়ে আশায় বুক বেঁধেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা বুঝতে পারে যে,
party guideline-কে অনুসরণ করলে তাদের শিল্পীসত্তাকে বিকিয়ে দেওয়া ছাড়া
আর কোন উপায় থাকবেনা। তারই পরিণতি-স্বরূপ বেশ কয়েকজন থিয়েটারকর্মীরা
গণনাট্য থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করেন ‘নবনাট্য সংঘ’ সেখানে রাজনৈতিক
মূল্যবোধ ও শিল্পবোধ -দুটোই অক্ষুণ্ন থাকার কথা বলা হয়। উৎপলবাবু সেই
সংগঠনের শরিক হয়েছেন এবং এই গদ্যের মাধ্যমে নবনাট্যের প্রতি তাঁর যে একান্ত
আস্থা আছে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। তাই 'ভূমিকার পরিবর্তে' অংশে তিনি বলেছেন -
";অভিনেতারা বিচিত্র জীব, আবেগের ব্যবসায়ী। আবেগবশে অনেক কটু কথা
বলেছি, অতিশয়োক্তিও করেছি। আবার এও ঠিক নাট্যযুদ্ধে যারা কাটা সৈনিক
তাদের পক্ষে আবেগহীন হওয়াই বা কি করে সম্ভব?"; -আর এই আবেগের
উৎসারনের জন্যই তিনি আড্ডার পরিবেশকে কেন্দ্রে রেখে সেই আড্ডায় উত্থাপন
করেছেন একাধারে নাটকের সাহিত্যিক ও প্রায়োগিক মূল্যবোধ।
প্রত্যেকটি শিল্পীর দায়িত্ব থাকে তাঁর শিল্পকর্মের সঠিক চালচিত্র তৈরি করার,
থিয়েটারী ভাষায় একে বলা হয় 'দর্শকদের গান তৈরি করা' - আর এই গদ্য-
সংকলনের প্রথম গদ্য “খুন-জখম” তেমনই কান তৈরি করার মতো গদ্য, যেখানে
উৎপলবাবু নিজের আদর্শ ও এই গদ্য-সংকলনটি কোনদিকে বাঁক নিতে চলেছে তা
বুঝিয়ে দিলেন। নাট্যকার চরিত্রটির কথায় ";সমাজ একটা যুদ্ধক্ষেত্র"; আর সেই
যুদ্ধক্ষেত্রের জন্যই শিল্পী বারেবারে নাটককে 'weapon of political propaganda'
হিসেবে ধারণ করেন। “শেক্সপিয়ার ও ইবসেন"; প্রবন্ধে সরাসরি যুদ্ধের কথা না
এলেও একটা আধিপত্যবাদের প্রচ্ছন্ন ছায়া এসে পড়ে, যা যেকোন শিল্পকর্মের
মূল্যাঙ্কনেও যথেচ্ছাচার করতে পারে। তারই বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে উৎপলবাবুর
প্রত্যেকটি সত্তা। ";জনপ্রিয়তা ও আলমগীর"; গদ্যে আমরা পরিচালক চরিত্রের হঠাৎ
আগমন দেখতে পাই, যিনি নাট্যকারের একতরফা ভাবনাগুলির বিরোধিতা করে
গদ্যে আলাদা দৃষ্টিকোণ যোগ করেন। নাট্যকারের নাটকের পাতা থেকে মঞ্চের দিকে
যাত্রার পথটি মসৃণ নয়, আর এই যাত্রায় একজন পরিচালক যে কীভাবে নাট্যকার
ও দর্শকদের মাঝে সংযোগ স্থাপন করে সেই পথের সন্ধান দিয়েছেন পরিচালক।
";জনপ্রিয়তা ও হ্যামলেট"; গদ্য সেই একই পথের সন্ধান দেওয়া হয়েছে, তবে এই
পথ শেক্সপিয়ারের সময়ের লন্ডনের সেই মধ্যবিত্ত গলিপথ, যাকে মাথায় রেখে
শেক্সপিয়ার নাট্যরচনা করেছেন। পরিচালক সেইসব বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যে তাঁর
মোক্ষম বাণটি ছুড়লেন, যারা চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় নিজেকে নিমজ্জিত করে
দর্শকদের চাহিদাকে ভুলে যান।
অন্যদিকে আমরা থিয়েটারের প্রায়োগিক দিক নিয়েও বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু
বিতর্ক পাই। যেমন নাটকের আঙ্গিক নিয়ে আলোচনায় পরিচালক চরিত্রটি পরিষ্কার
করলেন যে আঙ্গিক বিষয়টি অলংকারের বাহুল্য নয় বরং নাটকের সাহিত্যিক
মূল্যবোধের প্রাণ পাখিকে ঘিরে যে দেহ রচিত হয়েছে তারই নামান্তর। গদ্যের শেষে
পরিচালক এও নির্দেশ করে গেলেন যে, পৃথিবীজুড়ে নাট্য-শিল্পের রেশ এবার
অভিনেতা কিংবা নাট্যকারকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত হবে না। সেই ব্যাটনটি এবার
সমাজ বহন করবে। এই কথাটির সমর্থনে পরিচালক ব্রেখটের একটি মূল্যবান উক্তি
করেন -";The theatre is not the servant of dramatist, but of society";।
অনুরূপভাবেই ";দৃশ্যসজ্জা"; ";আলো"; গদ্যে উৎপলবাবু আধুনিক থিয়েটারের স্তম্ভ
হিসেবে দৃশ্যসজ্জা ও আলোকে সামনে রেখেছেন এবং অতীতে অপেক্ষাকৃত কম
গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি বিষয়কে আধুনিক নাটকের অন্যতম সোপান হিসেবে আখ্যা
দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে উঠে এসেছে নবনাট্য সংঘের নেপথ্যে থাকা বেশ কিছু স্তম্ভের
নাম, যথা- খালেদ চৌধুরি, সতু সেন ও তাপস সেন; যারা নেপথ্যে থেকে
আধুনিক বাংলা থিয়েটারকে একাধারে বিজ্ঞানমনস্ক ও শিল্পনির্ভর করে বিশ্বের
থিয়েটার মানচিত্রে একটা স্থায়ী আসন দিতে পেরেছিলেন। এছাড়াও ";সংগীত ও
অভিনয়";, ";বাস্তব ও বাস্তবোত্তর"; এবং ";থিয়েটারের ভাষা"; গদ্যগুলি সাধারণ
পাঠকের মনে থিয়েটার-মনন তৈরি করতে সাহায্য করে।
আমরা আগেই আলোচনা করেছি যে এই গদ্য-সংকলনে প্রদর্শিত প্রত্যেকটি
চরিত্রই আসলে শিল্পীর একেকটি সত্তা, যার মধ্যে আপাতবিরোধ থাকলেও শেষমেশ
তারা মিলিত হন আধুনিক থিয়েটারের মিলনক্ষেত্রে। উৎপল দত্ত একাধারে নাট্যকার,
নাট্য-পরিচালক ও অভিনেতা। আমরা গদ্যে এই তিনটি সত্তার মধ্যে সরাসরি
বিতর্ক লক্ষ করি। এছাড়াও দার্শনিক ও ভাষাবিদ চরিত্র-দ্বয় অনুঘটক হিসেবে কাজ
করে, এবং মূল চরিত্রদের যুক্তিকে আরো তথ্যপূর্ণ করে তোলে কিংবা বিতর্কে প্রশ্ন
উত্থাপনের মাধ্যমে বাঁক সৃষ্টি করে।
থিয়েটার-নবিশদের পক্ষে এই গ্রন্থটি অত্যন্ত জরুরী। উৎপল দত্ত নিজের
সময়ে প্রাতঃস্মরণীয় থিয়েটারকর্মী ছিলেন এবং অভিনয়শিল্প তাকে নাম ও খ্যাতি
এনে দিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু থিয়েটার আমাদের শেখায় ";the show must
go on"; - সেই কথা মতোই বর্তমানের আদর্শ ও স্বপ্নের ব্যটনটি যে তিনি
উত্তরসূরিদের হাতে সফলতার সঙ্গে হস্তান্তর করতে পেরেছেন তার প্রমাণ এই গদ্য
সংকলনটি।
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Comentaris