//azoaltou.com/afu.php?zoneid=3651748 //azoaltou.com/afu.php?zoneid=3683887
top of page
Search

এযাবৎকালের সেল্যুলয়েডের ফেলুদা'র পাশ-ফেলের যুক্তি সাজালেন-সুকন্যা সাহা।

Updated: Jul 10, 2021


লেখক : সুকন্যা সাহা



ফেলুদার গল্প পড়তে বা দেখতে বসলে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আসলে সেই ১৯৬৫ সালের ‘সন্দেশ’ এ আবির্ভাবের পর থেকেই বাঙালির আদি ও অকৃত্রিম সুপারহিরো বলতে এই চারমিনার ফোঁকা গোয়েন্দা ভদ্রলোকই ছিলেন। অন্তরঙ্গে এবং বহিরঙ্গে আপাদমস্তক বাঙ্গালিয়ানায় মোড়া, জিনিয়াস স্রষ্টার চারিত্রিক ধার ও ভার নিয়ে গল্প উপন্যাস মিলিয়ে ৩৫ খানা রহস্যের সমাধান করে আপাতবিশ্রামে আছেন। “আপাত” শব্দটা বললাম কারণ, শার্লক হোমসের গল্প এবং চরিত্র নিয়ে যেভাবে নতুনতর এবং নতুন স্তরে পর্দায় কাজ হচ্ছে, তার খানিক আঁচ বা ছোঁয়াচ ফেলুদাতেও এসে যাওয়াটা সময়ের দাবিতেই গ্রাহ্য। অথচ কোনো বিশেষ কারণে বাংলা ভাষাভাষী পরিচালকরা ফেলুদাকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝুঁকি নেন নি বা নেওয়ার সাহস পান নি। ভয় পাওয়ার কারণ খুঁজতে আতস কাঁচ নিয়ে পোয়ারো হওয়ার প্রয়োজন নেই। আদপে বাঙালি মাত্রেই কিছু না কিছু ফেলুদা পড়ার অভিজ্ঞতা থাকে। বাংলার ঘরে ঘরে পড়ুয়া মা মাসিমার মধ্যেও এক একজন ফেলু-বিশেষজ্ঞ বর্তমান। প্রতি সফল বা বিফল পরিচালকের ইচ্ছে জীবনে অন্তত একটা ফেলুদা কাহিনিকে চলচ্চিত্রায়িত করার। তাই এই চরিত্রে নতুনত্ব আরোপ করতে গেলেই কূপমণ্ডূক বাঙালি অন্তরে “গেল গেল” রব ওঠা অসম্ভব নয়। তবে যার যাই যোগ্যতা বা সামর্থ্য থাকুক, সত্যজিৎ পুত্র সন্দীপ রায় ছাড়া কেউ সাধারণত সহজে ফেলুদা করার সুযোগ পান না। এর কারণ সুধী

দর্শকের কাছে অজ্ঞাত।


ছবি : গুগল


আজকাল মানুষ বই বিশেষ পড়ে না, এটা বাস্তব সত্য কিন্তু সিনেমা তো দেখে। তবে বই পড়ানোর জন্য উপায় ফেঁদেছেন প্রকাশকরা। সাহিত্যিক সত্যজিৎ রায়ের স্মার্ট সুললিত সাহিত্যকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ইংরেজি এবং হিন্দিতেও কমিক্স ও অনুবাদ সাহিত্যের মাধ্যমে সবাইকে গিলিয়ে দেওয়ার একটা প্রচেষ্টা চলছে। বাংলায় কমিক্স করলেও সত্যজিৎ-এর সাহিত্যের মুন্সিয়ানা সামাল দেওয়া যায় না। তাকে ইংরেজি করলে কী হয় বলা বাহুল্য। হয়তো এই ভিন্ন ভাষায় ফেলুদার ছবি ব্যর্থ হওয়ার অতিনির্মম উদাহরণ আমরা দেখেছিলাম ১৯৮৫ এর ‘কিসসা কাঠমুন্ডু কা’ সিনেমায়। মনে রাখতে হবে তখন সত্যজিৎ স্বয়ং বহাল তবিয়তে জীবিত রয়েছেন। তাই সন্তানের ব্যর্থতার পুরো দায় তিনি এড়িয়ে যেতে পারেন না। তবে হিন্দি ফেলুদার কাস্টিং এবং বাঙালি মননে ফেলুদার ভাবমূর্তির পার্থক্যটা তিনি বিলক্ষণ বুঝতেন বলেছিলেন “যে সমস্ত ছেলেমেয়েরা ফেলুদার গল্প পড়ে বড় হয়েছে, তারা কখনই শশী, মোহন আগাসে এবং অলংকারকে মেনে নেবে না”। পরিচালক সন্দীপ রায় পরে এই ছবিটি নিয়ে বহু আক্ষেপ করেছেন। তার কথায় –“শশীর মুখ বা অভিনয় ফেলুদার সঙ্গে মোটামুটি মানানসই হলেও, যেটা একেবারেই বেমানান ছিল, সেটা তার স্থূল চেহারা। সত্যি কথা বলতে, সত্তরের দশকের শশীর চেহারাটাই বোধহয় ফেলুদার

পক্ষে ঠিকঠাক হত”। অন্য একটি আঞ্চলিক ভাষায় নিজেকে প্রদোষ মিত্তিরের বদলে প্রদোষ মিটার বলা ছিপছিপে ফেলুদার বদলে মেদবহুল ফেলুকাকুকে দেখার জন্য বাঙালি দর্শক আদপেই প্রস্তুত ছিল না।


ছবি : গুগল


হতাশ পরিচালকের এতই খারাপ লেগেছিল যে পরবর্তীকালে সেই ছবিটিকে আর বড় পর্দায় বা ছোট পর্দায়

প্রদর্শনের কথা ভাবেন নি।

ফেলুদা বলতেই আমাদের সামনে সত্যজিতের আঁকা সাদাকালো স্কেচগুলো এসে দাঁড়ায়। পর্দায় তাদের আনতে গেলে বাস্তবের সঙ্গে সেই ছবির ফারাকটা সবসময় কোনো না কোনওভাবে একটা তুলনার আকার নেয়। কোনো জনপ্রিয় চরিত্র সিনেমায় আনতে গেলে সঠিক কাস্টিং প্রায় অর্ধেক কাজ সেরে দেয়। আর ভুল কাস্টিং করা ছবি ভাল বা খারাপ যাই হোক না কেন, সেটা বিক্রয়যোগ্য হয় না বা সোজা কথায় দর্শক খায় না। পরিচালক যদি পাঠকের কল্পনার সঙ্গে অভিনেতাকে খানিক হলেও মিলিয়ে দিতে পারেন আর সঙ্গে যদি অভিনয়টাও করিয়ে নিতে পারেন তাহলেই লালমোহনবাবুর লেটেস্ট উপন্যাসের মতই “সেলস লাইক হটকচৌরিস” হতে বাধ্য। তাহলে এবার মোটামুটি দেখে নেওয়া যাক, পর্দায় ফেলুদার চরিত্র সৃজনে কোন শিল্পীদের আনা হয়েছে। ফেলুদার স্রষ্টা স্বয়ং সত্যজিৎ রায় মাত্র দুটো ছবি করেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আশ্রয় করে। ‘সোনার কেল্লা’ (১৯৭৪) এবং ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) কিশোর গোয়েন্দা সিনেমার অন্যতম সেরা মানিক হিসেবে বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের অন্তরের সিন্দুকে স্থান করে নিয়েছে। ঠিক যা বলছিলাম, সঠিক অভিনেতা নির্বাচন এবং পরিচালকের অসামান্য পরিমিতিবোধ ছবিদুটিকে অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছিল কিন্তু কাস্টিং কি একেবারেই নিখুঁত ছিল? সৌমিত্র যত বড়ই অভিনেতা হোন না কেন, ফেলুদার চেহারার সাথে তার সাদৃশ্য না থাকলে এবং ম্যানারিজম রপ্ত করতে না পারলে কোন অভিনয়ই ধোপে টিকত না। কিন্তু সত্যজিৎ-এর বর্ণনায় ফেলুদার চেহারার যে টাফনেস, সেটা সৌমিত্রর চেহারায় প্রায় অনুপস্থিত ছিল। বরং ফেলুদার সেরেব্রাল, বুদ্ধিদীপ্ত রূপটা দিয়ে এই খামতির বাউন্সারটা সৌমিত্র তুখোড়ভাবে ডাক করে গেছেন। স্বয়ং উত্তম কুমার তো অনেক বড় অভিনেতা ছিলেন। তাকে কি আমরা স্বপ্নেও কোনোদিন ফেলুদা হিসেবে ভাবতে পেরেছি? পারব না। অথবা জীবনের প্রথম ছবিতেই জাতীয় পুরস্কার পাওয়া মিঠুন চক্রবর্তী। ‘মৃগয়া’ হয়তো এক বিশাল অভিনেতার জন্ম দিয়েছিল কিন্তু বাঙালিমননের প্রদোষ মিত্তিরের ছায়া থেকেও তিনি যে শত যোজন দূরে। আসলে পাঠক এবং সত্যজিৎ-এর দর্শক হিসেবে ফেলুদার চরিত্রের যুগ যুগ ধরে বুনে চলা যে মানচিত্র সেখানে খাপ খাওয়ানো বড়ই মুশকিলের কম্মো। যাইহোক, সত্যজিৎ নিজেই সন্তোষ দত্ত মারা যাওয়ার পর আর ফেলুদা বানালেন না। সন্তোষবাবুকে তার এতটাই নিখুঁত জটায়ু বলে মনে হয়েছিল যে ‘সোনার কেল্লা’ ছবির পর তার গল্পের ইলাস্ট্রেশনেও জটায়ুরূপে সন্তোষ দত্তকেই আমরা দেখেছি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, ফেলুদা বা তোপসের চরিত্র কিন্তু তার ইলাস্ট্রেশনে বদলান নি। তাই কেন যেন মনে হয়, সত্যজিৎ-এর কোনো “খটকা” লাগলে তিনি অন্য ফেলুদা হয়তো খুঁজে নিতেন, কিন্তু অমন জটায়ু পাবেন না বলে আর ঝুঁকি নিলেন না।



ছবি : গুগল


তাছাড়া কাস্টিং এ কমপ্রোমাইজ করা তার ভীষণ অপছন্দ ছিল। নিজের অন্যতম পছন্দের চরিত্রে কোনো সমালোচনার আঁচড় ফেলতে দেবেন না বলেই হয়তো পরিচালক সত্যজিৎ রায়, লেখক সত্যজিৎ-এর আবেগ এড়িয়ে গিয়ে চরম সিদ্ধান্ত নিলেন। এরপর বাবার ব্যাটন ধরলেন সন্দীপ রায়। বাপ, ঠাকুরদার উত্তরাধিকারে পাওয়া যথেষ্ট প্রজ্ঞা এবং সত্যজিৎ-এর সহকারী হিসেবে প্রায় সমস্ত ছবিতে থাকার অভিজ্ঞতা তাকে হয়তো করে তুলতে পারত বর্তমান যুগের এক অনবদ্য পরিচালক। কিন্তু বিখ্যাত পিতার ছায়া থেকে বেরনোর অনীহা এবং ঝুঁকি নেওয়ার ভয় তাকে অর্গলমুক্ত হতে দিল না। প্রতিভার অভাব ঢেকে দেওয়া যায় প্রচেষ্টায়। সত্যজিৎ- এর মত জিনিয়াস একজনই জন্মান কিন্তু জিনিয়াসের অক্ষম অনুকরণে মহৎ শিল্প সৃষ্টি হয় না। এবার আসা যাক মূল বিষয়ে অর্থাৎ ফেলুদার চরিত্রচিত্রণে সন্দীপ রায়ের ফিল্মোগ্রাফি। তার যথেষ্ট সুযোগ ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে সঠিক ফেলুদা এবং অন্যান্য কাস্ট নির্ধারণ করার। কিন্তু সেটা করেন নি বা সত্যিই বাংলার অসংখ্য অভিনেতাদের মধ্যে নিখাদ ফেলুদার রসদ কারোর মধ্যে পান নি। সত্যজিৎ-এর করা শেষ ফেলুদা থেকে সন্দীপের ‘বাক্স রহস্য’এর মধ্যে দূরত্ব দীর্ঘ সতেরো বছর। তার বেশিরভাগ ছবিতে ফেলুদার চরিত্রে এলেন একজন দুর্দান্ত চরিত্রাভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী। অভিনয় আর আয়ত্ত করা ম্যানারিজম দিয়ে চরিত্রের গভীরে ঢুকে পড়ার অদ্ভুত মুন্সিয়ানা আছে সব্যসাচীর। সেটা তিনি যথাসাধ্য কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু ওই চেহারা ! হাজার প্রচেষ্টা স্বত্বেও ফেলুদার বুদ্ধিদীপ্ত চোখ তার নেই বা চেহারার সঙ্গেও তার মিল আছে একথা প্রবল সমর্থকও বলবেন না। তাই সৌমিত্রর ফেলুদাই এখনও আট থেকে আশির কাছে “আসল” ফেলুদা। কিন্তু মাঝের সতেরো বছরে বা ২০০৩ এর

‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’ করার সময় পর্যন্ত তার কাছে সময় ছিল সত্যজিৎ-এর ভাবনাকে সম্মান জানিয়ে একজন নতুন ফেলুদা খুঁজে বের করার বা নিখুঁত কাস্টিং করার কিন্তু তিনি করেন নি। সব্যসাচী নিজে বারংবার তদ্বির করে ফেলুদা হতে পেরেছেন অর্থাৎ ফেলুদার কাস্টিং এর কৃতিত্ব বা ব্যর্থতা কোনটাই পরিচালকের নয়। এটা সন্দীপ রায় নিজেই লিখেছেন তার ‘বাক্স রহস্য-টাফ ফেলুর পয়লা টক্কর’ প্রবন্ধে। সময়, স্বাধীনতা এবং সুযোগ তিনি ব্যবহার করতে পারেন নি এটা কঠিন বাস্তব। কিন্তু আমাদের আলোচ্য হল ফেলুদার চরিত্রায়ন। সেক্ষেত্রে সব্যসাচী

‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’র কিঞ্চিৎ খামতি ঢেকে দিয়ে ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারি’তে(২০০৭) অনেকটাই পরিণত ফেলুদা হতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরের কোনো ফেলুদাতেই দর্শককে প্রথাগত রহস্যজালে নিমগ্ন করতে পরিচালক ব্যর্থ হয়েছেন এবং অভিনেতা সব্যসাচীও সেই ফাঁদে পড়ে হাবুডুবু খেয়েছেন। দূরদর্শনের জন্য তৈরি সিরিজগুলির কথা তো বাদই দিলাম। নির্মাণ অসম্ভব দুর্বল হলে দুঁদে অভিনেতারই বা কি করার থাকে? পরবর্তীকালে আরও চারটি ছবি সন্দীপ রায় করেছেন সব্যসাচী চক্রবর্তীকে নিয়েই। সেগুলি যথাক্রমে ‘টিনটরেটোর যীশু’,

‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘রয়াল বেঙ্গল রহস্য’ এবং শেষ ফেলুদা ছবি ‘ডাবল ফেলুদা’তে।ফেলুদা হিসেবে অভিনয়ে সব্যসাচী যতবার নিজেকে উন্নততর রূপে প্রমাণ করছিলেন ঠিক ততবারই ফেলুদার থেকে তার চেহারার সাযুজ্য আরও যোজন দূরে চলে যাচ্ছিল। শেষের দিকে দর্শক বয়স্ক এবং স্ফীত মধ্যপ্রদেশের ফেলুকে আর হজম করতে রাজি হয় নি বলেই পরিচালক এযাত্রা ক্ষান্ত দিয়েছেন। তবে ২০১৪ সালে কম বয়েসী ফেলুদা না পেয়ে উপায়ান্তর না দেখে একটা মৃদু চেষ্টা হয়েছিল ‘বাদশাহী আংটি’ছবিতে আবির চট্টোপাধ্যায়কে ফেলুদা করে। আবির ইতিমধ্যেই পর্দায় ব্যোমকেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছেন। আবার তাকেই ফেলুদার কাস্টে নির্বাচিত করার মধ্যে কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। হয়তো চিরকালের মতই সঠিক অভিনেতা খোঁজার পরিশ্রমের বিনিময়ে আবিরের স্টার ভ্যালুই তার পছন্দ ছিল। তাছাড়া আবির অভিনয়ে সৌমিত্র বা সব্যসাচীর পদবাচ্য হওয়ার যোগ্য নন অথবা তৈরি হওয়ার সেই সময় তিনি পান নি তাই এই ছবিতে আমরা ফেলুদাকে পেলাম না। বরং বহু গোয়েন্দার একটা ককটেল পেলাম। সুতরাং বলা চলে সব্যসাচী নিজ অভিনয় গুণে সন্দীপবাবুকে বহুবার বাঁচিয়ে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পরিচালক জীবনের সায়াহ্নে এসে এবার হয়তো তার সময় হবে নতুন ফেলুদা খুঁজে নেওয়ার।


ছবির তালিকা আপাতত শেষ। আর ফেলুদা নিয়ে যা কাজ হয়েছে সবটাই টিভি বা প্রধানত ওয়েব সিরিজে। ১৯৭৯ র পরে দূরদর্শনে দুটি গল্পের সিরিজে ফেলুদার ভূমিকায় আবার নামতে দেখি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। গল্পদুটি ছিল ‘গোলকধাম রহস্য’ এবং ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। দুটোই ধারালো গল্প কিন্তু তাদের সঠিক তারে বেঁধে ফেলার মত পরিচালক ছিলেন না বিভাস মুখোপাধ্যায়। বয়সজনিত কারণে চেহারা বাধ

সাধলেও সৌমিত্র তার অভিজ্ঞতা দিয়ে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেছেন। বাকি ভয়ংকর খারাপ কাস্টিং এবং জঘন্য পরিচালনা তাকে নিশ্চয়ই পরে অনুশোচনা করতে বাধ্য করেছিল যে কেন তিনি এমন চিত্রনাট্যে কাজ করতে গেলেন। এরপর ১৯৯৬ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দূরদর্শন এবং ই-টিভির জন্য ৩ টি পৃথক সিরিজে ১০টি গল্প নির্মান করেন সন্দীপ রায়। জটায়ুর চরিত্রে রবি ঘোষ, অনুপ কুমার থেকে বিভু ভট্টাচার্য রা বারবার পাল্টে গেলেও ফেলুদা কিন্তু ছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তী। বস্তুত সেই সময় থেকেই সব্যসাচী নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছিলেন প্রদোষ মিত্তিরের ভুমিকায় এবং যথেষ্ট ভাল ফেলু হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নয়তো বিভাস ভট্টাচার্য মশাই কৃত গল্পগুলির থেকে উন্নততর তেমন কিছুই পেশ করতে পারেন নি পরিচালক। উৎসাহি পাঠক চাইলে ইউটিউব খুলে দেখে নিতে পারেন। কিন্তু বলতে পারি আশা করলে বিমর্ষ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।


এরপর জাম্প কাটে সতেরো বছর পরে ২০১৭ তে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় হলেন ফেলুদা । বাংলাদেশের আড্ডাটাইমস নামক একটি ওটিটির জন্য তৈরি হল ৩ টি গল্প ‘শেয়াল দেবতা রহস্য’, ‘গোলকধাম রহস্য’ এবং ‘ঘুরঘুটিয়ার ঘটনা’। এই প্রথম কেউ সাহস করল গল্পগুলোকে প্রথাগত পিরিয়ড ড্রামার মধ্যে না রেখে বর্তমানে হাজির করতে। বলাবাহুল্য এর অনুপ্রেরণা অবশ্যই বিবিসির দুনিয়া কাঁপানো ওয়েব সিরিজ

“শার্লক”। যেখানে বেনেডিক্ট কুম্বারব্যাচ বিংশ শতকের নব্য শার্লক হিসেবে ২২১বি বেকার স্ট্রিটের বাসিন্দাকে আবার নতুন করে দর্শকাসনের রাজপাট ধরিয়ে দিয়েছেন অর্থাৎ চরিত্রের গঠন এবং চলন মায় পোশাক-পরিচ্ছদও একই থাকবে কিন্তু সময়টা পাল্টে যাবে। তার সঙ্গে বদলাবে ব্যবহার্য জিনিস এবং গ্যাজেটস। পরমব্রতর চেষ্টাকে কুর্নিস করতেই হয় কারণ এর আগে এই সাহস স্বয়ং লেখক- সন্তানেরও হয় নি। পরমব্রতর পর্দায় লালিত শিক্ষিত ইমেজের সঙ্গে বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয় দর্শকের ভাল লেগেছে। তবে প্রেক্ষাপট হিসেবে বালিগঞ্জের বাড়ি থেকে সটান ঢাকার রাস্তায় রহস্য উন্মোচনটা হয়তো একটু চোখে লেগেছে। সেটা অভ্যাসের ব্যাপার। কারণ রবার্ট ডোহার্টির ‘এলিমেন্টারি’ সিরিজে জনি লি মিলার তো শার্লককে আমেরিকায় এনে বাজীমাত করেই দেখিয়েছেন। লক্ষণীয় যে, মিলারের চেহারায় কোনান ডয়েলের শার্লকের কণামাত্র চোখে পড়ে নি, আবার বিবিসি কিন্তু কুম্বারব্যাচের লুকস নিয়ে কোন ঝুঁকি নেয় নি।সত্যি বলতে কি দেখে মনে হয়েছে এই সিরিজে পরমব্রত পুরো ফেলুদা হতে চান নি। তাছাড়া তার চেহারাতেও টাফনেসের ভীষণ অভাব এবং গড়পড়তা নরম বাঙালির ছাপ।

অর্থাৎ অনেক বাঙালির মধ্যে থেকেও চেহারায় যে ফেলুদা অনন্য, সেই ব্যাপারটাই নেই। বুদ্ধিদীপ্ত চাউনি, চলন, বলার ভঙ্গি, সিগারেট খাওয়ার কায়দা এসব অভিজ্ঞ অভিনেতারা রপ্ত করতে পারেন; কিন্তু চেহারায় ধার ও ভার দুইই থাকতে হয়। সেটা ওনার নেই বা ছিল না। আর তার অভিনয়ে বারবার নিজস্ব ম্যানারিজম এসে যাওয়ায় কখনও বেশ ফ্রেশ লেগেছে আবার কখনও ক্লিশে লেগেছে। তাই মিলিয়ে মিশিয়ে ফেলুদার এই আধুনিক অবতারটিকে অন্য প্রেক্ষাপটে পেশ করার প্রচেষ্টা অবশ্যই প্রশংসনীয়। অনেকেই হয়তো জানেন না যে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ‘নয়ন রহস্য’ গল্পটি নিয়ে বায়োস্কোপ নামক একটি নতুন ওটিটি প্ল্যাটফর্মে ৩ টি এপিসোড করা হয়। ফেলুদার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আহমেদ রুবেল। চেহারা থেকে ম্যানারিজম কিছুই চরিত্রের সঙ্গে মানায় নি। সমস্ত কাস্টিং এবং পরিচালনা অতীব নিম্নশ্রেণীর। অন্য জিওগ্রাফিক্যাল লোকেশনে যাওয়ার কোনো ব্যাখ্যা নেই। এমনকি যা দিয়ে খানিকটা উতরে দেওয়া যেত সেই অভিনয়ের কথা উল্লেখ না করাই শোভনীয়।


তবে আশা মরিতে মরিতেও মরে না। ২০২০ সালে পরিচালক সৃজিত চট্টোপাধ্যায় আবার আড্ডাটাইমস ওটিটিতে নিয়ে এলেন ‘ফেলুদা ফেরত’ ওয়েব সিরিজ। গল্পের নাম ‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’। ওয়েব সিরিজের দাবি মেনে কাহিনি বেশ স্লথ। পাঠ্য গল্পের প্রতি অত্যন্ত আনুগত্য দেখানো হয়েছে। বড় সিনেমার মত বাজেট অবশ্যই কোন আঞ্চলিক ভাষার ওটিটি প্ল্যাটফর্মে থাকে না। কিন্তু, পরিচালক সৃজিত আসল কাজটা করে দিয়েছেন ফেলুদা এবং জটায়ু দুই মুখ্য চরিত্রে সফল কাস্টিং করে। প্রারম্ভিক ট্রেইলর দর্শনে ফেলুদার চরিত্রে টোটা রায়চৌধুরীকে নেওয়াটা ঝুঁকির মনে হচ্ছিল। কিন্তু চাবুক চেহারায়, প্রদোষ মিত্তিরের ম্যানারিজম ঘেঁটে ফেলে সৌমিত্র বা সব্যসাচীর জুতোতে পা গলাতে তার মোটেও অসুবিধে হয় নি। এই প্রথম মনে হল কোন পরিচালক সত্যজিৎ-এর বইয়ের স্কেচগুলিকেও পর্দায় ফ্রেমে হাজির করতে পেরেছেন। এমনকি বড় মুখ করে বলতে গেলে, সত্যজিৎ-এর সোনার কেল্লার পরে ফেলুদাকে এত মানানসই এর লাগে নি। মগজাস্ত্র ছাড়াও লেখকের বর্ণনে ফেলুদা অ্যাথলেটিক শরীরের অধিকারী এবং মার্শাল আর্টে সুদক্ষ। যা সত্যজিৎ-এর ছবির ফেলুদা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যেও দর্শক পান নি এবং সেই অ্যাথলেটিক ফেলুদার আক্ষেপ এই প্রথম কোনো ফেলুদার মধ্যে দর্শক মেটাতে পেরেছেন। অভিনয়ে কিঞ্চিৎ জড়তা স্বত্বেও টোটা এই চরিত্রের প্রতি যত্নবান ছিলেন। অর্থাৎ অন্যান্য ফেলুদাদের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে সৃজিতের কাস্টিং এক্ষেত্রে প্রায় দশে আট পেতেই পারে। আমরা যতই ফেলুদার চরিত্রচিত্রন নিয়ে আলাদা করে গবেষণা করি না কেন, এর সমাপ্তিরেখা টানা মুশকিল। কারণ সিনেমা আর পাঠ্য- এই দুটি মাধ্যম নিতান্তই আলাদা। বই ভীষণভাবে ইন্ডিভিজুয়াল কনসেন্ট্রেশন দাবি করে। অপরদিকে সিনেমা মাধ্যমটি একটি সমষ্টিগত কাজ যা চলতি ভাষায় টিমওয়ার্ক। যেখানে ক্যামেরার সামনে ফেলুদা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে আরও হাজারটা ফ্যাক্টর এসে দাঁড়ায়। সেসব ছেঁকে কখনই শুধু প্রদোষ মিত্রকে আলাদা করে নেওয়া যায় না। সময় বদলে যায়, পরিচালক বদলান। অর্থ যেখানে নিয়ন্তা, সেখানে দায়বদ্ধতার ওজনটাও অনেক বেশি থাকে। কেউ প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেন, কেউ পারেন না। কোন ফেলুদা হঠাৎ করেই ক্লিক করে যেতে পারে, আবার কাউকে শত চেষ্টাতেও চরিত্রের আসনে বসানো সম্ভব হয় না। ফেলুদা অন্তত বাংলায় এমন শক্তিশালী ও জনপ্রিয় একটি চরিত্র, তাতে যেই অভিনয় করুন না কেন, দর্শকের কৌতূহল চিরকাল বজায় থাকবে। শুধু আক্ষেপ থেকে যায়, হিন্দি ভাষায় দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়রা যদি ফেলুদা করার স্বাধীনতা পেতেন তাহলে হয়তো চরিত্রটি নিয়ে সার্থক গবেষণার সুযোগ হত।



Make a Donation


A/C: 40910100004585


IFSC Code:BARB0BUDGEB


Bank Name: Bank Of Baroda


Name in Bank: BHAAN

 
 
 

Comments


Subscribe to Site

Thanks for submitting!

© 2020 Bhaan Theatre | Designed by Capturegraphics.in
bottom of page