কোন কালচারে ভর দিয়ে মমতা জেতেন, বামের পালে ফেরে না হাওয়া' আলোচনায় - দেবরাজ কুমার
- Avijit Mitra
- May 30, 2021
- 10 min read
Updated: Jun 5, 2021
রাজনৈতিক সংস্কৃতির রূপান্তর: পশ্চিমবঙ্গ
দেবরাজ কুমার
রাজনৈতিক হিংসা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও নাগরিক অধিকারের সংকোচনের দীর্ঘ পর্ব
শেষে ১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের বুকে বামফ্রন্ট সরকারের প্রতিষ্ঠা একটি ঐতিহাসিক
পর্বান্তর রূপেই ইতিহাসে চিহ্নিত। বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম লক্ষ্যই ছিল
গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
"… শপথ গ্রহণের পর প্রথম বৈঠকেই বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা রাজনৈতিক আনুগত্য
নির্বিশেষে সমস্ত (রাজনৈতিক) বন্দিকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। কংগ্রেসি
আমলে অপহৃত গণতন্ত্র ও নাগরিক স্বাধীনতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই এই সিদ্ধান্ত
নেওয়া হয়েছিল। এই মুক্তি পাওয়া বন্দিদের ১৭০০ জন ছিলেন কংগ্রেস ও বিভিন্ন
নকশালপন্থী গোষ্ঠীর নেতা ও কর্মী। … সরকারি কর্মচারীদের ওপর যেসব
দমনমূলক নির্দেশাবলি ছিল, সেগুলিও প্রত্যাহার করে নেওয়া হলো। বিনা বিচারে
আটক, বিচারাধীন মামলা—সংবিধানের ৩১১ (২) (গ) ধারায় যে সব সরকারি কর্মীকে
বরখাস্ত করা হয়েছিল, তাঁদের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধাসহ চাকরিতে পুনর্বহাল
করা হলো। রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ফিরিয়ে আনা হলো…
… শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে এই সরকার প্রতিষ্ঠিত করে।
সংগঠন গড়ার অধিকার দেওয়া হয় পুলিস কর্মীদের। … রাজ্যে পঞ্চায়েত ও
পৌরসভাগুলিকেও সক্রিয় করে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হলো। দীর্ঘদিন ধরে এইসব
স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলির নির্বাচন করা হয়নি। এগুলির ক্ষমতাও ছিল অত্যন্ত
সীমিত। পঞ্চায়েত আইনকে সংশোধন করে ত্রিস্তর-পঞ্চায়েতি ব্যবস্থা চালুর
উদ্যোগ নেওয়া হলো। [জ্যোতি বসু, পৃষ্ঠা ৩৪৪-৩৪৫]"
এই সব পরিবর্তনের সূত্রে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে লক্ষণীয়
রূপান্তর আসে। এক, অর্ধদশক ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা ও রাষ্ট্রীয়
সন্ত্রাসের দমবন্ধকর পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হয় বাঙলা। দুই, গণতান্ত্রিক সভা-
সমাবেশ ও ট্রেড ইউনিয়ন রাজনীতির পরিসর বৃদ্ধি পায়। তিন, মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু
বলেছিলেন, ‘আমরা শুধু রাইটার্স বিল্ডিং থেকে সরকার চালাব না’। সরকারি ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে এই নীতি প্রতিফলিত হয়। পঞ্চায়েত ও পৌরসভার নিয়মিত
নির্বাচনের মাধ্যমে সমাজের একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত নির্বাচনী রাজনীতির
প্রসার ঘটে এবং সেই সূত্রে সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ অনেক বৃদ্ধি পায়।

ছবি : গুগল
চার, ভাগচাষিদের উচ্ছেদ রোধের জন্য ‘অপারেশন বর্গা’–র পাশাপাশি খেতমজুরদের
ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত হয়; ভূমি সংস্কারের সূত্রে বড়ো বড়ো কৃষিজমির মালিকের
অবলুপ্তি ঘটে। এইভাবে, সদ্যপ্রতিষ্ঠিত বামফ্রন্ট সরকারের শক্তির সামাজিক
ভিত্তি রূপে আত্মপ্রকাশ করে ছোটো কৃষক, বর্গাদার ও নিম্নবর্গীয় কৃষকেরা।
বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের যে-গ্রামেই যান,
শুনতে পাবেন, সেইসব ‘পুরোনো’ দিনের কাহিনি, যখন জমিদার আর বড়োমানুষরা ছড়ি
ঘোরাত, যখন গরিবরা আর্থিক উৎপীড়ন আর সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হতেন…’।
[বামরাজ, পৃষ্ঠা ২-৩] ‘বামফ্রন্ট আমলে নিম্নবর্গীয়রা একধরনের সামাজিক মর্যাদা
পেয়েছেন, যেটা তাঁদের আগে ছিল না’ – এ-কথা স্বীকার করেছেন বামফ্রন্টের ঘোর
সমালোচক অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারও। [বামরাজ, পৃষ্ঠা ৪৮-৪৯]।
উপরিউক্ত সদর্থক পরিবর্তনগুলির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে একটি ‘নেতিবাচক
পরিবর্তন’-ও ক্রমে বামফ্রন্ট জমানার বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছিল। সেটি হল
পার্টিতন্ত্রের প্রকোপ বৃদ্ধি ও ‘পার্টি সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠা। [‘পার্টি সমাজ’-এর
বৈশিষ্ট্য রূপে উল্লেখ করা হয় -- ১) পার্টি ভিন্ন অন্য কোনো নাগরিক উদ্যোগ ও প্রতিষ্ঠানের
অনুপস্থিতি, ২) রাজনৈতিক পরিসরে জাতপাত, ধর্ম, জনগোষ্ঠী প্রভৃতি পরিচিতি-সত্তার উপেক্ষিত
ভূমিকা, ৩) সংঘাত ও হিংসার চরিত্র দলীয়, ৪) সামাজিক জীবনে পার্টির ‘নৈতিক অভিভাবকত্ব’, ৫)
পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় পার্টির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ।] পার্থ চট্টোপাধ্যায় ব্যাখ্যা করে
বলেছেন:

ছবি : গুগল
"১৯৭০-এর দশকে পশ্চিমবাংলায় দলীয় হানাহানির কথা অনেকের মনে
থাকবে। তাতে প্রাণহানি হয়েছিল বিস্তর। দলাদলির হিংসার সঙ্গে জুড়ে
গিয়েছিল ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তখন দলতন্ত্র ছিল না, ছিল দলীয়
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভেতরে গভীর অস্থিরতা। অর্থাৎ দল সেখানে
কোনো পাকাপোক্ত শাসনপদ্ধতির অঙ্গ হয়ে ওঠে নি। সেটা ঘটল
বামফ্রন্ট শাসনে। … বাম শাসনের গোড়ার দিকে ভূমি সংস্কার, পঞ্চায়েত
ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলে ভূস্বামীদের
সামাজিক প্রতিপত্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের যে ঢেউ বয়ে গিয়েছিল, তাতে
পশ্চিমবাংলার গ্রাম সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে যায়। এই পরিবর্তন
সাধারণভাবে প্রগতিশীল বলেই স্বীকৃত হয়েছে। কিন্তু তার ফলে চিরাচরিত
যে প্রতিষ্ঠানগুলি গ্রামসমাজের দৈনন্দিন জীবন নিয়ন্ত্রিত করত,

ছবি : গুগল
অর্থাৎ জমিদার অথবা জাতি পঞ্চায়েত অথবা ধর্মীয় নেতা বা
প্রতিষ্ঠান, সেগুলি খুব দ্রুত লোপ পেল, নয়তো ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ল।
এই পরিবর্তনকেও নিশ্চয়ই প্রগতিশীল বলতে হয়, কারণ এইসব
প্রতিষ্ঠানের সনাতন নিয়ন্ত্রণপদ্ধতি দাঁড়িয়ে ছিল সম্পত্তি কিংবা
জাতপাত কিংবা পুরুষতন্ত্র কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠের শাসনাধিকারের ওপর।
কিন্তু পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলি ভেঙে পড়ার পর সমাজ পরিচালনার জন্য
নতুন কোন প্রতিষ্ঠান কি তৈরি হলো? দেখা গেল, একটি প্রতিষ্ঠানই
সমস্ত নিয়ন্ত্রণক্ষমতা গ্রাস করেছে। সেটা হল পার্টি। স্কুল বলুন,
ক্লাব বলুন, পুজো বলুন, যাত্রা-থিয়েটার বলুন, সব কিছু পরিচালনার
দায়িত্ব নিল পার্টি। [জনপ্রতিনিধি, পৃষ্ঠা ১২-১৩]"
পার্থ চট্টোপাধায় অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘পার্টি’ মানে তিনি সব সময় সি-
পি-আই-এমকেই যে চিহ্নিত করছেন তা নয়, যে-পার্টির যেখানে আধিপত্য সেখানে
তারাই এই পার্টিতন্ত্র তথা পার্টি-সমাজ কায়েম করেছে। তবে যেহেতু সিপিএম-এর
শৃঙ্খলা ও সাংগঠনিক নির্দেশমূলক কাঠামোটি ছিল অন্যদের তুলনায় অধিকতর পটু,
তাই তাদের নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোটি সবচেয়ে নিশ্ছিদ্র হয়েছে।
আজ আমরা ফিরে-তাকিয়ে বুঝি, বামফ্রন্ট সরকারের ঘোষিত নীতি ‘ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণ’ হওয়া সত্ত্বেও এবং বাম জমানায় নিয়মিতভাবে স্থানীয় নির্বাচনগুলি
সম্পন্ন হলেও সমাজের প্রায় প্রতি ইঞ্চিতে পার্টিতন্ত্রের প্রসার যথার্থ
গণতন্ত্রের বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। সরকার ও পার্টি সমার্থক
হয়ে গিয়েছিল বাম আমলে; এমনকি এ-ও বলা যায়, লোকাল পার্টি অফিসই হয়ে উঠেছিল
পঞ্চায়েত বা পৌরসভার বিকল্প প্রতিষ্ঠান। কমিউনিস্ট পার্টির এ-হেন সামাজিক ও
রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণপদ্ধতিটির উৎস হিসেবে অনেকে লেনিনবাদী সাংগঠনিক
পদ্ধতির মডেলটির কথা বলেন। কিন্তু লেনিনীয় মডেলটির উদ্ভব ঘটেছিল বিপ্লববাদী
রণনীতির জরুরি প্রয়োজন থেকে। দীর্ঘ বামফ্রন্ট জমানায় দেখা গেল সেই বিপ্লববাদী
রাজনৈতিক অনুশীলনের ধারাটি শুকিয়ে গেছে, কেবল পড়ে রয়েছে পার্টির শুষ্ক
নিয়ন্ত্রণবাদী কাঠামোটি। এটাই অধঃপতিত পার্টিতন্ত্র। কমিউনিস্ট পার্টি আর
বিপ্লব সম্পন্ন করার হাতিয়ার রূপে কাজ করল না, বরঞ্চ তা হয়ে উঠেছিল যাবতীয়
সামাজিক, পারিবারিক ও ব্যক্তিগত বিবাদের মীমাংসাকারী। এক্ষেত্রে ভোট-রাজনীতির
নিজস্ব বিবেচনা ও সমর্থকগোষ্ঠীকে তুষ্ট করা প্রধান বিবেচ্য ছিল। কমিউনিস্ট

ছবি : গুগল
কর্মীদের আত্মত্যাগের দীর্ঘ ঐতিহ্য সত্ত্বেও একটানা ক্ষমতাভোগ পার্টির মধ্যে
কায়েমি স্বার্থ ও আমলাতন্ত্রের প্রসার ঘটিয়েছিল। সরকারে থাকার দৌলতে এমন
অঞ্চলেও পার্টির সাংগঠনিক প্রসার ঘটেছিল যেখানে বাম আন্দোলনের কোনো অতীত
ঐতিহ্য ছিল না। শহর ও মফসসলে পার্টি সংগঠনের মজবুত ভিত্তি তৈরি হয়েছিল
সরকারি কর্মচারী ও শিক্ষক সমাজের মধ্যে, যা কমিউনিস্ট রাজনীতিকে শুধুমাত্র
একটা ‘ভদ্রলোক’ চরিত্রই দেয়নি, তাদের মধ্যে একটি সুবিধাভোগী স্তরও তৈরি
করেছিল। গ্রামাঞ্চলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পার্টি-নেতৃত্বের রাশ চলে গিয়েছিল ছোটো
ও মধ্য কৃষকদের কিছু পরিবারের হাতে, যার ফলে ভূমিহীন কৃষক ও খেতমজুরদের
স্বার্থগুলি অবহেলিত হতে শুরু করে। এইভাবে গরিব মানুষের মধ্যে বামফ্রন্টের
সমর্থন-ভিত্তি ক্রমে আলগা হতে থাকে; তথাপি দীর্ঘদিন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসীন
থাকতে পেরেছিল গ্রহণযোগ্য বিকল্পের অভাবে। এটা ঠিকই, বামফ্রন্ট-বিরোধী
ভোটের শতাংশ দীর্ঘ বাম জমানায় কোনোদিনই ৩৫ শতাংশের নিচে নামেনি, কিন্তু
বিরোধী-রাজনীতি ছিল কলকাতাকেন্দ্রিক ও বহুধাবিভক্ত, গ্রামাঞ্চলে তাদের
সাংগঠনিক ভিত্তিও পাকাপোক্ত ছিল না। এ-ক্ষেত্রে একুশ শতকে একটা লক্ষণীয়
রূপান্তর ঘটেছিল। পার্থ চট্টোপাধ্যায় ২০০৯-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে
দেখিয়েছিলেন, রাজ্যস্তরে বামফ্রন্টের অপ্রতিহত প্রভাব সত্ত্বেও ২০০৩ সাল
থেকে গ্রামস্তরে সিপিআইএম-এর গণভিত্তি ক্রমহ্রাসমান। ২০০৩-এ গ্রাম
পঞ্চায়েতের এক-তৃতীয়াংশ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি কুক্ষিগত করেছিল; ২০০৮-এ
অর্ধেকের বেশি বিরোধীদের হাতে চলে যায়। [বামরাজ, পৃষ্ঠা ৭] নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুরের
জমি আন্দোলন এবং তা নিয়ে নাগরিক সমাজের শোরগোল ও মিডিয়ার নিরন্তর সিপিএম-
বিরোধী প্রচার ক্রমহ্রাসমান বাম-সমর্থনের প্রক্রিয়াকেই শেষ আঘাত দিয়েছিল।
তবে, প্রণব বর্ধন যথার্থই লিখেছেন, বামফ্রন্ট-বিরোধী সার্বিক গণ-অসন্তোষের
ব্যাখ্যা শুধুমাত্র জমি অধিগ্রহণ-বিরোধী কৃষক অসন্তোষের মধ্যে খুঁজলে ভুল হবে,
‘এর আরও বড়ো কারণ হল, স্থানীয় জীবনযাপনের সমস্ত দিকের ওপর পার্টির
সর্বময় উৎপীড়ক নিয়ন্ত্রণ যেভাবে বসেছিল তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও তীব্র
অসন্তোষ’। (বামরাজ, পৃষ্ঠা ২৯)। এই ‘অসন্তোষ’ এতটাই ছিল যে রাজ্যের
পশ্চিমাঞ্চলে (যা এখন ‘জঙ্গলমহল’ নামে উল্লিখিত হচ্ছে) ‘মাওবাদী’ শক্তির হাতে
প্রায় তিনশোর মতো বাম-কর্মীর মৃত্যুও পশ্চিমবঙ্গের গরিষ্ঠ মানুষের মনে বামেদের
প্রতি সহানুভূতি জাগাতে পারেনি।

ছবি : গুগল
ফলস্বরূপ ২০১১ সালে রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ ঘটল। নানা স্তরের মানুষের বিপুল
সমর্থন নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙলার মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন হলেন।
বামফ্রন্ট সরকারের জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে কৃষিজমি রক্ষার আন্দোলনে
সরকার-বহির্ভূত বামপন্থী সংগঠনগুলিকে ও নাগরিক সমাজের বামমনোভাবাপন্ন
একাংশের বুদ্ধিজীবীকে পাশে পেয়েছিলেন তিনি। জঙ্গলমহলে ও নন্দীগ্রামে মাওবাদী
শক্তির সমর্থন ছিল তাঁর সঙ্গে। গরিব কৃষক, প্রান্তিক আদিবাসী, অসংগঠিত
শ্রমিক, দলিত ও মুসলমান সমাজের ব্যাপক সমর্থন ছিল তাঁর পক্ষে। মমতা নিজেও
ছিলেন অতি-সাধারণ পরিবারের মেয়ে; তাঁর জীবনযাপনের ধরন ও কথাবার্তার সঙ্গে
পরিশীলিত ভদ্রলোক সত্তা বহুলাংশে খাপ খায় না। এই সব নানা কারণে কোনো কোনো
বামপন্থী লেখক মমতার মধ্যে ‘ভদ্রলোক বামপন্থা’-র বিকল্প এক ‘সাবলটার্ন
বামপন্থা’-র অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন। এই ধরনের চিত্রায়ন কতখানি সঙ্গত, সেই
আলোচনায় আসব। কিন্তু তার আগে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র গরিব ও প্রান্তিক
মানুষের সমর্থনই যে মমতার পক্ষে ছিল তা নয়, কমিউনিস্ট-বিরোধী দক্ষিণপন্থী
শক্তির যথেচ্ছ সমর্থনও তিনি পেয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেস ও ভারতীয় জনতা পার্টির
মতো সর্বভারতীয় দল ছিল তাঁর দিকে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সূতিকাগার রাষ্ট্রীয়
স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের অতি-প্রিয় চরিত্র ছিলেন তিনি এবং দীর্ঘ কমিউনিস্ট জমানার
অবসান তাদের উল্লসিত করেছিল। দেশের বাইরেকার পুঁজিবাদী শক্তির উচ্ছ্বাসও ছিল
চোখে পড়ার মতো। সমাজের তৃণমূল স্তরে বামেদের বিপ্লবী রাজনীতি পথভ্রষ্ট হয়েছিল
নিশ্চয়, কিন্তু তাদের চিন্তায় ও তত্ত্বে রয়ে গিয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের
উত্তরাধিকার—ভারতে অর্থনৈতিক উদারবাদ ও কর্পোরেট-নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির
তারাই ছিল প্রধান সমালোচক। সুতরাং বামেদের ঘাঁটি হিসেবে চিহ্নিত পশ্চিমবাংলা
থেকে কমিউনিস্টদের উৎখাত করতে পারলে কর্পোরেট ও বৃহৎ পুঁজির মালিকদের
পথের কাঁটা যে অনেকটাই নির্মূল হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বভাবতই মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এই রাজনৈতিক পরিবর্তনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়েছিল
এবং হিলারি ক্লিনটন নিজে এসেছিলেন দেখা করতে মমতার সঙ্গে। বি-বি-সি নিউস
হেডলাইন করেছিল, “The world’s longest serving elected communist
government has been voted out”।
বস্তুত, মমতাকে বামপন্থী বা ডানপন্থী রূপে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করার পথে
সবচেয়ে বড়ো অসুবিধা হল তাঁর রাজনীতিতে চিরকালই ভাবাদর্শের গুরুত্ব কম, মূলত
ভাবাবেগ ও সুবিধা-মতো কৌশল গ্রহণই তাঁর রাজনীতির মূল অবলম্বন। এই কারণে বি-
জে-পির মতো হিন্দুত্ববাদী শক্তির সহযোগী হতে তাঁর বাধেনি। লক্ষনীয়, বাবরি
মসজিদ ভাঙার পরে, এমনকি গুজরাটের ভয়ঙ্কর দাঙ্গারও পরে, যখন বি-জে-পির
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি জলের মতো স্বচ্ছ হয়ে জনসমক্ষে ধরা পড়েছে, তখনও তাদের
সঙ্গলাভ মমতার কাছে ‘লজ্জাজনক’ বিবেচিত হয়নি। কৌশল মতো কংগ্রেসের
সমর্থনও তিনি নিয়েছেন। বস্তুত, প্রাক্-২০১১ পর্বে মমতার আপাত অসংলগ্ন
রাজনীতির মধ্যে একটি মাত্র অভিন্ন ঐক্যসূত্রই আমরা লক্ষ করি—তা হল তীব্র
থেকে তীব্রতম সিপিএম-বিরোধিতা। ২০১১-র পূর্ববর্তী মুহূর্তে যে-নব উপাদানটি যোগ
হয়েছিল তা হল তিনি তাঁর সি-পি-এম-বিরোধিতায় কিছু বাম দল ও বাম সংগঠনকে পাশে
পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু লক্ষ করে দেখবার যে, বামফ্রন্ট-বিরোধী বামপন্থী শক্তির
সমর্থন (যার মধ্যে অসংসদীয় বামেরাও রয়েছে) তাঁর দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলির সঙ্গে
দূরত্ববৃদ্ধির কারণ হয়নি। বলা যেতে পারে, অতি-বাম থেকে অতি দক্ষিণপন্থীদের
সিপিএম-বিরোধী অভিযানে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, এবং যেহেতু ইতিমধ্যে সিপিএম
গরিব ও সাধারণ মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাই গরিব ও প্রান্তিক মানুষের
উদ্দীপিত সমর্থনও তাঁর সঙ্গে ছিল।
রাজনৈতিক পালাবদল-পরবর্তী জমানায় শাসন-পদ্ধতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির
ক্ষেত্রে পূর্বতন আমলের কিছু ধারাবাহিকতা ও কিছু নতুন প্রবণতা যুক্ত হল।
ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছিলেন দলতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে
সত্যিকারের গণতন্ত্রের সূচনা ঘটাবেন, কিন্তু তার তেমন লক্ষণ দেখা গেল না।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সমাজ-বিজ্ঞানীসুলভ অন্তর্দৃষ্টি ব্যবহার করে ২০১১-
তেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘পার্টি সমাজ’-এর আশু পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা নেই;
২০০৯ থেকে যে-সব পঞ্চায়েতে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এসেছে সেখানেও
দলতন্ত্রের একই ছবি। তাঁর ভাষায়, ‘অসংগঠিত ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মধ্যবিত্ত
শ্রেণির সামাজিক প্রতিপত্তির ফল হিসেবে আইন-বহির্ভূত রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
ব্যবস্থা, এমনকি বেআইনি বলপ্রয়োগের যে প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছিলাম [মূল
প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য], দলীয় ক্ষমতার সমীকরণ বদলালেও সেই প্রক্রিয়ার বদল
হওয়ারও বিশেষ সম্ভাবনা নেই।‘ [বামরাজ, পৃষ্ঠা ১২] পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুমানই
ঠিক হল, ২০১১-র পরবর্তী কালে দল-বহির্ভুত সাধারণ নাগরিকের ক্ষমতায়নের
কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। অথচ ‘দলহীন’ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন ও নাগরিক
সমাজের আস্থা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছিল। মুশকিল হল, সেই গণ-উদ্দীপনা ও নাগরিক
আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী হল না; রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এনে, নিজেদের সব অধিকার ও
দাবি-দাওয়া একজন নেত্রীর সদিচ্ছা ও মহানুভবতার কাছে জিম্মা রেখে রাজনীতির
রঙ্গমঞ্চ থেকে তারা আবার ফিরে গেল নিষ্ক্রিয় ‘উপভোক্তা’-র অবস্থানে। আর
বুদ্ধিজীবীরা ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া ও সরকারি দাক্ষিণ্যের বিনিময়ে নতুন
সরকারের স্তাবকে পরিণত হলেন। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াও নির্ভেজাল
স্তুতির পথ বেছে নিল সরকারি বিজ্ঞাপনের আশায়। ফলে, ২০১১-র ‘পরিবর্তন’
গণতন্ত্রের বিকাশের পথে মাইল-ফলক হয়ে উঠতে পারল না।
প্রায়োগিক স্তরে যতই বিকৃতি ঘটুক বামফ্রন্ট তত্ত্বগতভাবে ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণ নীতি মেনেছিল, কিছু সদর্থক আর্থসামাজিক পরিবর্তনেরও কারণ
হয়েছিল; তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় তার বালাই নেই। এই জমানায় সব সিদ্ধান্তই
একটি কেন্দ্র থেকে, নেত্রীর মস্তিষ্ক ও মর্জি থেকে নির্গত হয়। এই
এককেন্দ্রিক কাঠামোটিতে যেটুকু বাত্যয় ও ফাঁকফোকর চোখে পড়ে তা ক্ষমতার
বিকেন্দ্রীকরণজাত নয়, তা দল হিসেবে তৃণমূল কংগ্রেসের অগোছালো কাঠামোটির
জন্যে। এই অগোছালো ভাব কখনও যেমন নৈরাজ্যের কারণ, নিয়ন্ত্রণহীন রাজনৈতিক
হিংসার কারণ, তেমনই আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে পার্টিতন্ত্রের ফাঁসটাও আলগা
রাখে। তার সুফল স্থানবিশেষে স্থানীয় মানুষ ভোগ করে কিছুটা। লক্ষ করা যেতে
পারে, বিরোধী রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে বামকর্মী ও সংগঠনের প্রতি নয়া জমানা
সদয় নয় মোটেই, তাদের প্রতি ‘কেউটে সাপের মতো’ ব্যবহারের নিদান হাঁকা হয়,
কিংবা বলা হয় ‘আগামী পঞ্চাশ বছর চুপ’ করে থাকতে, মিথ্যা মামলায় তাদের ফাঁসানো
হয়, কিন্তু সাধারণ নির্বিবাদী ‘অ-রাজনৈতিক’ মানুষকে কাছে টানতে একগুচ্ছ পদক্ষেপ
সরকার নিয়েছে। "গণতন্ত্র" মানে যদি সিদ্ধান্তগ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ বোঝায়,
মানুষের ‘ক্ষমতায়ন’ মানে যদি স্বনির্ভর হয়ে দাঁড়ানো বোঝায়, তাহলে পরিবর্তন-
উত্তর পশ্চিমবঙ্গ নিশ্চয় সেই প্রবণতার ধারে-কাছে নেই; কিন্তু দুর্নীতি, ‘কাটমানি’-
র অভূতপূর্ব প্রসার সত্ত্বেও সরকারি সুযোগ-সুবিধা, পরিষেবা ও দাক্ষিণ্য সাধারণ
মানুষের কাছে পৌঁছে দেবার ক্ষেত্রে এই সরকারের সাফল্য আমাদের নজর এড়ায় না।
[ফেসবুকে জনৈক শ্যামল মুখার্জির একটি বিশ্লেষণ এখানে উল্লেখ করি: “তৃণমূল কি তোলা তুলছে
না? তোলা অবশ্যই তৃণমূল তুলছে। কিন্তু তা তো সংখ্যাগরিষ্ঠ গরীব মানুষের থেকে না। তুলছে
মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তের কাছ হতে। হ্যাঁ, গরীবের কাছ থেকেও নিচ্ছে। কিন্তু কি ভাবে? ওই গরীব
পরিবারের জন্য কোনো সরকারি স্কিম থেকে কুড়ি হাজারের ব্যবস্থা করে সেখান থেকে পাঁচ হাজার
আত্মসাৎ করছে। তাতে তো ওই গরীব পরিবারটির কোন অসুবিধা হওয়ার কথা না।…প্রায় সবাই
সরকার থেকে অল্পবিস্তর প্রত্যক্ষ সাহায্য পাচ্ছে। আগেও বাম সরকার দিত, এর থেকে বেশি
দিত, কিন্তু সেটা পরোক্ষভাবে, যেমন ভর্তুকি, ফসলের সহায়ক মূল্য ইত্যাদি। সাইকেল বা
অনুদানও দিত কিন্তু এইভাবে সকলকে না। ফলে মানুষ আমাদের দিকে (বামফন্টের দিকে) ফিরছে
না।“]
একদিকে সর্বময় নেত্রীর একনায়কসুলভ শাসন, অন্যদিকে দলীয় শৃঙখলার
অভাব—এই দুইয়ের বৈপরীত্য কী-ভাবে নতুন জমানা মোকাবিলা করে তা নিয়ে সংশয়
প্রকাশ করেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় ২০১১ সালের ওই লেখাটিতে। প্রশ্ন ছিল,
সর্বময় নেত্রী কি তৃণমূল কংগ্রেসকে একটি আঁটোসাঁটো শৃঙ্খলাবদ্ধ পার্টিতে
রূপান্তরের উদ্যোগ নেবেন, নাকি অন্য কোনো উপায় অবলম্বন করবেন? আমরা
দেখলাম এ-ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নেত্রী সহজতর পথটি বেছে নিলেন। এই দুর্বলতা তিনি
ঢেকে দেবার চেষ্টা করলেন আমলাতন্ত্রকে ব্যবহার করে—স্থানীয় ‘বিশৃঙ্খল’ নেতার
থেকে একজন আমলাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেহেতু সহজ। তৃণমূল জমানায় আমরা দেখব,
বহু অঞ্চলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা পার্টি নয়, কিছু বিশ্বস্ত আমলাই হয়ে ওঠেন
সর্বময় নেত্রীর নির্দেশের বাহন। কোনো কোনো জেলায় পুলিশ প্রশাসক তথা
আধিকারিকের হাতেই স্থানীয় পার্টির মূল দায়িত্বভার ন্যস্ত করেন তিনি (২০১১-
পরবর্তী কালে জঙ্গলমহলে বিশেষভাবে দেখা গিয়েছিল এই কৌশল)। বিরোধী
রাজনৈতিক কন্ঠস্বরকে স্তব্ধ করতে পুলিশ প্রশাসনের ব্যবহারও সেই কৌশলের
অঙ্গ। বস্তুত এই জায়গায় পূর্ববর্তী বাম জমানার সঙ্গে তৃণমূলের রাজনৈতিক
সংস্কৃতির প্রভেদটি লক্ষণীয়। অভিযোগ আছে, বহু অঞ্চলে বাম জমানাতেও স্থানীয়
পার্টি-নেতৃত্ব স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করত বিরোধী রাজনীতিবিদদের
কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে; তৃণমূল জমানায়ও পুলিশ প্রশাসন একই লক্ষ্যে নিয়োজিত,
তবে স্থানীয় পার্টি-নেতৃত্বের বশংবদ হয়ে নয়, সর্বোচ্চ নেত্রীর সরাসরি আস্থায়
বলীয়ান হয়ে। অর্থাৎ বাম জমানার মতো লোকাল পার্টি এ-ক্ষেত্রে প্রশাসন বা
সরকারের স্থান নিচ্ছে না, বরং প্রশাসন বা সরকারই লোকাল পার্টি হয়ে উঠছে।
তৃণমূল জমানার রাজনৈতিক জনসমাবেশের আর একটি নতুন প্রবণতা
আইডেন্টিটি পলিটিক্স বা জাতি ও গোষ্ঠী ভাবাবেগকে ব্যবহার, বামফ্রন্ট জমানায়
যেটি চাপা পড়ে ছিল বা উপেক্ষিত হয়েছিল। সুমন নাথ ই-পি-ডাব্লু পত্রিকাতে
প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বাঁকুড়ার আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষার
ভিত্তিতে (২০০৮-২০১৪) তুলে ধরেছেন, জনসমর্থন লাভের লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেস
কী-ভাবে সি-পি-এম-এর থেকে ভিন্ন ‘পন্থা’ অনুসরণ করেছে সেখানে। সিপিএম-এর
কৌশলটি ছিল ‘পার্টি সমাজ’-এর কৌশল – আদিবাসী জনসমাজকে স্থানীয় পার্টি-
নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল রাখা। অন্যদিকে টি-এম-সি (তৃণমূল কংগ্রেস)-র কৌশল
হল--সাঁওতাল সমাজের চিরাচরিত থাকবন্দি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে ব্যবহার করে
আদিবাসী সমাজের আনুগত্যলাভ এবং সাঁওতালদের সাংস্কৃতিক উৎসবে ঢালাও
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বন্দোবস্ত। ‘মাঝি’ বা গ্রাম-প্রধানেরা গ্রামসভাগুলির
সভায় তৃণমূলকে সমর্থনের জন্যে মূলত চারটি যুক্তি উপস্থাপন করত। এক, তৃণমূল
তাদের শিকার উৎসবে অর্থসাহায্য করবে এবং প্রত্যেকটি আদিবাসী নৃত্যগোষ্ঠী
কলকাতার দুর্গোৎসবে অনুষ্ঠান করার সুযোগ পাবে; দুই, গ্রামবাসীদের পঞ্চায়েতের
কাজে লোকাল পার্টির দ্বারস্থ হতে হবে না, ‘মাঝি’-রাই সরাসরি পঞ্চায়েতে তাদের
কথা পৌঁছে দেবে; তিন, তৃণমূল কংগ্রেস আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মাওবাদী সংশ্রবের
‘মিথ্যা’ মামলাগুলি প্রত্যাহার করে নেবে; চার, পুরোনো বি-পি-এল তালিকা সংশোধন
করে নতুন তালিকা প্রস্তুত করা হবে। সুমন নাথ জানিয়েছেন, এই সব সভাগুলিতে
সবচেয়ে বেশি সময় ধরে আলোচিত হত আদিবাসী উৎসব উদযাপনের খুঁটিনাটি, এবং
এমন আড়ম্বর ব্যাপ্তি ও উদ্দীপনার সঙ্গে এই উৎসব পালিত হতে শুরু করে যার
দৃষ্টান্ত অতীতে ছিল না। বিপুল পরিমাণ সরকারি অর্থও উৎসব মেলা প্রভৃতির
পিছনে ব্যয়িত হয়। [ই পি ডাব্লু, ভল্যুম ৫৩, সংখ্যা ২৮, ১৪ জুলাই ২০১৮]
গোর্খা, রাজবংশী পরিচিতি-সত্তাকে তুষ্ট করার পথে একই ভাবে নতুন সরকার
হেঁটেছে। নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার বিপুল মতুয়া সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের
লক্ষ্যে মতুয়া মহাসংঘের ‘বড়ো মা’-কে পৃষ্ঠপোশকতা ও আনুগত্যের সম্পর্কে
বেঁধেছেন মমতা এবং তার ফলে বিগত বছরগুলি মতুয়া ঠাকুরবাড়ি অভূতপূর্ব রাজনৈতিক
দড়ি-টানাটানির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মধ্যস্থতায়
ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আনুগত্যকে চিরস্থায়ী করার অভিপ্রায়ে তাঁদের ভাতা
প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। জমিয়ত উলেমা-ই-হিন্দের সভাপতি সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী
ও ফুরফুরা শরীফের পিরজাদা ত্বহা সিদ্দিকিকে ‘তুষ্ট’ করেছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের
ধর্মীয় ভাবাবেগের কাছে আবেদন জানিয়েছেন একই ভাবে। রাজ্যের সমস্ত
দুর্গাপুজোগুলিকে ৫০,০০০ টাকা অনুদানের মতো অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে দেখা
গেছে। ‘পুরোহিত ভাতা’ চালু করেছেন। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের এই
নীতিগত বাঁকের জন্যেই পশ্চিমবঙ্গে সর্বপ্রথম জাতপাত, ধর্মীয় ও অন্যান্য
পরিচিতি-সত্তার রাজনীতি সামনের সারিতে এসে গেছে। কেউ কেউ এ-ও বলে থাকেন,
রাজনীতির এই নয়া পরিভাষা ও বাঁক-বদলই ভারতীয় জনতা পার্টির হিন্দুত্ববাদী
আইডেনটিটি পলিটিক্সের জমি তৈরি করে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে।[সজ্জন কুমার, দি
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৫ মে, ২০২১] বামেদের হঠিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান বিরোধী দল
হিসেবে বি-জে-পি-র উত্থান অবশ্য আরও গভীর ও বিস্তারিত বিশ্লেষণের দাবি করে।
সেই আলোচনায় আপাতত ঢুকব না। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে,
মিছিল-জনসভার ভাষা-ব্যবহারে, গত দশ-বারো বছরে যে একটা রূপান্তর ঘটে গেছে তা
নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রাজনীতি-অর্থনীতির বিশ্লেষণ, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ
ইত্যাদি এক সময় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সভা-সমিতির আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু
ছিল, এখন তার স্থান নিয়েছে এক অদ্ভুত ‘অ-রাজনীতি’—চপল ডি-জে নাচ, "খেলা হবে"-
র মতো গান, চিত্রতারকাদের ’ইন্দ্রজাল’। জনসমর্থন লাভের কৌশল হিসেবে ধর্মীয়
মন্ত্রপাঠ কিংবা হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদের নির্লজ্জ উচ্চারণ ও সাম্প্রদায়িক ঘৃণার
প্রকাশ্য উসকানি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এখন রাজনীতির চর্চা ও অনুশীলনের মধ্যে
সমাজ বদলের, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির রূপান্তরের কোনো প্রতিশ্রুতি ও আশাবাদ
জড়িত নেই। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে উগ্র ফ্যাসিস্ত জমানার পদধ্বনি আপাতত
রুখে দেওয়া গেছে বটে, কিন্তু রাজনীতির ধরন ও কর্মসূচির বিদ্যমান ধারাটির বদল না
ঘটলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে কতটা স্বস্তি পাওয়া যাবে তা নিয়ে চিন্তার অবকাশ তাই
থেকেই যায়।
সূত্রনির্দেশ
জ্যোতি বসু, যত দূর মনে পড়ে, এন-বি-এ, কলকাতা, ১৯৯৮
প্রাবৃট দাসমহাপাত্র, রাজেশ ভট্টাচার্য (সম্পা), বামরাজ তত্ত্ব ও চর্চায়, চর্চাপদ, কলকাতা,
২০১৩
পার্থ চট্টোপাধ্যায়, জনপ্রতিনিধি, অনুষ্টুপ, কলকাতা, ২০১৩
Suman Nath, ‘Cultural Misrecognition’ and the Sustenance of Trinamool Congress in West
Bengal’, Economic & Political weekly, Vol 53, issue no. 28, 14 July, 2018
Sajjan Kumar, ‘How TMC has eased BJP’s way in Bengal’, The Indian Express, May 15 May, 2021
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Comments