//azoaltou.com/afu.php?zoneid=3651748 //azoaltou.com/afu.php?zoneid=3683887
top of page
Search

কীর্তনের সুরে মিনে করা কয়েকটি রবীন্দ্র গান:প্রথম পর্বেই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা পাড়লেন-কবিতা চন্দ


কবিতা চন্দ


কীর্তনের সুরে মিনে করা কয়েকটি রবীন্দ্রগান

কবিতা চন্দ


পর্ব ১

বাংলায় বৈষ্ণবীয় লীলাকীর্তন যেমন আছে - তেমনি আছে কালীকীর্তন। আমরা

শ্রৌতধর্ম বৈষ্ণব অধ্যুষিত লীলাকীর্তনের‌ই দ্বারস্থ আজ। সকলের শ্রবণে

পদাবলীসূত্রে এক বাঁশির সুরকথার উপলব্ধি আছে। বাঁশি বলে ― রা-ধা, রা-ধা। ‛মধুরং

মধুরং মধুরং মধুরম’ ― সেই ধ্বনি। গোঠলীলাতে এই না বাঁশির সুর শুনে অলপবয়সী

রাধিকার রন্ধন আউলেছিল, মন‌ও ‛বেয়াকুল’ হয়েছিল। অতঃপর শ্রীহরি-শ্রীরাধিকার

মহামিলন আর মহাবিরহ।

শুধু পদাবলীর ভাষাশ্বৈর্যে রাধাকৃষ্ণ লীলার সবটা উপলব্ধি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ

তাকে কীর্তনে বেঁধে আপন-মনের-মাধুরী সঞ্চারিত করেছিল ― সত্যরূপে। যুগে যুগে

সেই গানের আঙ্গিক পরিবর্তিত হতে হতে একালে আমাদের কাছে যে রূপে ধরা দিয়েছে

― তা সঙ্গীতপ্রিয় মানুষ মাত্রেরই শ্রবণামোদিত হয়েছে। বাঙালি এই হৃদয়স্পর্শী

সুরে পদাবলী কীর্তনের মাধ্যমে দেবতাকে প্রিয় ভাবতে ভাবতেই প্রিয়র জন্য‌ যেন

তা সঞ্চয় করেছে। কীর্তন এখন ফুল বেলপাতা হাতে নিয়ে নয়, যে-কোনো পরিবেশ

পরিস্থিতিতেই মানবমনকে উতলা করে দিতে পারে। একালের কীর্তনের সু্রমহিমা

এমনি। এই কীর্তনের সুর টান দেয় দুঃখে। মান দেয় ভালোবাসার। ধন দেয় প্রেমানুভবে।


বেদনাদূতী গাহিছে, ‛ওরে প্রাণ,

তোমার লাগি জাগেন ভগবান।


নিশীথে ঘন অন্ধকারে ডাকেন তোরে প্রেমাভিসারে


দুঃখ দিয়ে রাখেন তোর মান।


তোমার লাগি জাগেন ভগবান।.....

পরান দিয়ে প্রেমের দীপ জ্বালো।


সর্বানুভূতির যে কবি বাংলার কীর্তনের প্রতি অমোচ‍্য-আসক্ত ― তিনি

রবীন্দ্রনাথ। তাঁর অন্তরের যাবতীয় আলো, যাবতীয় বেদন প্রকাশ করেছে তাঁর গান।

সুরে লেগেছে ঐ অনুভবাদির পরশ। সেখানে কখনো সচেতনে কখনো আপনিই যেন এসেছে

কীর্তনের সুর। আনন্দে। দুঃখভরেও। মনোবিদ বলেন ― দুঃখ শব্দটি আপেক্ষিক।

দুঃখানুভূতির মূলে আছে সুখের স্মৃতি। কীর্তনের সুরে যেমন ভালোবাসা প্রকাশের

অবধি মেলে না ― তেমনি রবীন্দ্রগানে এর প্রয়োগে অনেক সময় দুঃখজনিত হারানো

সুখকেই বুঝি খুঁজে ফেরা হয়েছে। কিন্তু এসব কথায় রবীন্দ্রকথার সাক্ষ্য খুঁজে নিতে

হবে। প্রথমে ঐ ‛মধুরং মধুরং’ ― ভাবরূপের সন্ধানে দেখি রবীন্দ্রনাথ পদাবলীর

শব্দমাধুর্য কীভাবে পেয়েছেন।


বৈষ্ণবপদাবলী ধরা দিয়েছে তাঁর কবিতার শব্দ ছত্রে। এত গীতি, এত ছন্দ, এতভাবে

উচ্ছ্বাসিত প্রীতি, এত মধুরতার সুধা মর্ত‍্যনরনারীর অনুভব-নিরিখেই যে মূলত

আস্বাদ্য ― এ তাঁর উচ্চারণ। এও তো একপ্রকার কীর্তিগাথার জয়ধ্বনি। পদাবলীতে

যাঁর বা যাঁদের সেই কীর্তি, তাঁদের মধ্যে আদিতে শুধু ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ ―পরে রাধা

এসে দ্বৈতাদ্বৈত খেলা সম্পূর্ণ করেন। শ্রীমদভাগবতে দেখি : সোনার মতো উজ্জ্বল

পীতবাস পরনে, মাথায় ময়ূরপুচ্ছ, কানে কর্ণিকার ফুল আর গলায় বৈজয়ন্তীমালা

ধারণ করে শ্রীকৃষ্ণ যখন বাঁশি বাজাতে বাজাতে নিজ-লীলাস্থল বৃন্দাবনে প্রবেশ

করেছিলেন, তখন নাকি সেই অপরূপকে ঘিরে গোপীরা প্রথম তাঁর কীর্তি গান

করেছিলেন। যা পরবর্তীকালের সৃষ্টিতে রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তনে রূপ পেয়েছিল।

কৃৎধাতু জাত সেই মধুর সংগীত‌ই কীর্তন।


রবীন্দ্রনাথ জানান : কীর্তনে জীবনের রসলীলার সঙ্গে সঙ্গীতের রসলীলা

ঘনিষ্ঠভাবে সম্মিলিত। জীবনের লীলা নদীর স্রোতের মত নতুন নতুন বাঁকে বিচিত্র।

ডোবা বা পুকুরের মত ঘের দেওয়া পাড় দিয়ে বাঁধা নয় ― কীর্তনে এই বাঁধাধরায়

পরিবর্তমান ক্রমিকতাকে কথায় চেয়েছিল।


বললেন : কীর্তন সংগীত আমি অনেককাল থেকেই ভালোবাসি। ওর মধ্যে ভাব

প্রকাশের যে নিবিড় ও গভীর নাট্যশক্তি আছে সে আর কোন সংগীতে এমন সহজভাবে

আছে বলে আমি জানিনে।


বুঝতে চেয়েছেন এর আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য‌ও। জানিয়েছেন : বাঙালীর কীর্তন গানে

সাহিত্যে-সংগীতে মিলে এক অপূর্ব সৃষ্টি হয়েছিল। তাকে প্রিমিটিভ এবং

ফোকম্যাজিক বলে উড়িয়ে দিলে চলবে না। উচ্চ অংগের কীর্তন গানের আঙ্গিক খুব

জটিল ও বিচিত্র। তার তাল ব্যাপক ও দুরুহ, তার পরিসর হিন্দুস্থানী ( উত্তর-

ভারতীয় উচ্চাঙ্গসংগীত ) গানের চেয়ে বড়ো। তার মধ্যে যে বহু শাখায়িত নাট‍্যরস

আছে ― তা হিন্দুস্থানী গানে নেই।


এমন গানের কথাসম্পদ খুব অল্প বয়সেই রবীন্দ্রনাথের শ্রবণ হৃদয় আকৃষ্ট

করেছিল। একটি বিশেষ গানের কথা এই প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে। গানটির

পদকর্তা বিদ্যাপতি। বর্ষাঘনঘোরে মাথুরের বিরহকাতরতায় পূর্ণ সেই মূল গানটি

ছিল এমনি:


এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর।

এ ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন‍্য মন্দির মোর।।

ঝম্পি ঘন গর- জন্তি সন্ততি

ভুবন ভরি বরিখন্তিয়া।

কান্ত পাহুন কাম দারুণ

সঘনে খর শর হন্তিয়া।।

কুলিশ শত শত পাত-মোদিত

ময়ূর নাচত মাতিয়া।


মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী

ফাটি যাওত ছাতিয়া।।

তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

অথির বিজুরিক পাঁতিয়া।

বিদ্যাপতি কহে কৈছে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া।।


তখন রবীন্দ্রনাথের বয়স ষোল কি সতের। গঙ্গার ধারে একটি দোতলা বাড়ির

বারান্দা থেকে তিনি দেখলেন : নতুন বর্ষা নেমেছে। মেঘের ছায়া ভেসে চলেছে স্রোতের

উপর ঢেউ খেলিয়ে, মেঘের ছায়া কালো হয়ে ঘনিয়ে রয়েছে ও বনের মাথায়। অনেকবার

এইরকম দিনে নিজে গান তৈরি করেছি, [ স্মৃতিচারণটি বহুকাল পরের ] সেদিন তা হল

না। বিদ্যাপতির পদটি জেগে উঠল আমার মনে, ‛এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির

মোর’। নিজের সুর দিয়ে ঢালাই করে রাগিণীর ছাপ মেরে তাকে নিজের করে নিলুম।


রবীন্দ্রনাথের গানটির শুরুতে বিদ্যাপতির পদাবলীর প্রথম পংক্তিটির স্থান হল না।

এ গান হয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান, বিরহের গান, মেঘ-মল্লারে আর সামান্য

দেশ রাগে এই গানের সুরের চলনে এলো বর্ষাপ্রকৃতি-বর্ণন। কীর্তনের মতো

কথাকেই প্রাণদান এই গানের‌ও যেন লক্ষ্য ― তথাপি এ গানে কীর্তনের সুরের

আভাসটুকুও রাখলেন না তিনি। তবে এই গান নিয়ে তাঁর নানা উপলব্ধির প্রকাশ

চলতেই থাকল। কল্পনা পাখা মেলল।


সমগ্র পদটির মধ্যে আপাত সাধারণ একটি ছবি ― ‛মত্ত দাদুরী ডাকে ডাহুকী / ফাটি

যাওত ছাতিয়া।’ তার ব্যাখ্যায় জানালেন : এই ব্যাঙের ডাক নববর্ষার মত্তভাবের

সঙ্গে নহে, ঘনঘটার নিবিড় ভাবের সঙ্গে বড় চমৎকার খাপ খায়। মেঘের মধ্যে আজ

কোনো বর্ণ-বৈচিত্র্য নাই, স্তরবিন্যাস নাই, ― শচীর কোন প্রাচীন কিংকরী

আকাশের প্রাঙ্গণ মেঘ দিয়া সমান করিয়া লেপিয়া দিয়াছে, সমস্ত‌ই

কৃষ্ণধূসরবর্ণ।........... আসন্ন বৃষ্টির আশঙ্কায় পঙ্কিল পথে লোক বাহির হয় নাই।


এই রূপ জ‍্যোতিহীন, গতিহীন, কর্মহীন, বৈচিত্রহীন, কালিমালিপ্ত একাকার দিনে

ব্যাঙের ডাক ঠিক সুরটি লাগাইয়া থাকে। তাহার সুর ঐ বর্ণহীন মেঘের মতো, এই

দীপ্তিশূন‍্য আলোকের মতো, ....বর্ষার গণ্ডিকে আরো ঘন করিয়া চারিদিকে টানিয়া

দিতেছে।


অন্য আরেকটি প্রবন্ধে ভিন্ন প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এই গানটিকে স্মরণ করে

জানান : যাহাকে আমরা গীতিকাব্য বলিয়া থাকি অর্থাৎ যাহা একটুখানির মধ্যে

একটুখানি ভাবের বিকাশ এই যেমন বিদ্যাপতির ―

ভরা বাদর মাহ ভাদর

শূন্য মন্দির মোর


সেও আমাদের মনের বহুদিনের অব‍্যক্ত ভাবের একটি কোনো সুযোগ আশ্রয় করিয়া

ফুটিয়া ওঠা। ভরা বাদলে ভাদ্রমাসে শূন্য ঘরের বেদনা কত লোকের‌ই মনে কথা না

কইয়া কতদিন ঘুরিয়া ঘুরিয়া ফিরিতেছে ― যেমনি ঠিক ছন্দে ঠিক কথাটি বাহির হইল,

অমনি সকলেরই এই অনেকদিনের কথাটা মূর্তি ধরিয়া আঁট বাঁধিয়া বসিল।


রবীন্দ্রনাথ এক সময় বলেছিলেন এই গানটি তাঁর গানের ‛সিন্ধুক’-এ রাখা আছে।

রবীন্দ্রনাথের কীর্তনের সুর খচিত গানে ব্রজবুলি শব্দ প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই

চলে। কিন্তু এককালের কীর্তন যে-গানের শব্দাবলী, ভাব আশ্রয় করে নিজেকে

প্রকাশ করেছে; এক্ষণে আমরা দেখি যে রবীন্দ্রনাথ যেন সেটি আশ্রয় করেই নিজের

অন্তরের ভাবের সৌধ গড়ছেন। বিদ্যাপতির গানে বর্ষার এই ছবিতে আপন

বিরহীসত্তার অবয়ব দেখে দেখে অবধি পাচ্ছেন না তিনি যেন।


১৩১৭ সাল। ‛শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধমালার ‛শ্রাবণসন্ধ্যা’য় নিজের সুরে প্রায়শই

গাওয়া এই গানটি স্মরণ করেন তিনি। এরই একটি অংশ :

‛তিমির দিগভরি ঘোর যামিনী

অথির বিজুরিক পাঁতিয়া


বিদ্যাপতি কহে, কৈসে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া’ ― পংক্তিগুলি


উদ্ধৃত করে রবীন্দ্রনাথ লেখেন :

প্রহরের পর প্রহর ধরে এই বার্তাই সে জানাচ্ছে, ‛ওরে তুই যে চিরবিরহিনী’ (

অক্ষুন্ন রাখলেন রাধার ভাবটি ) তুই বেঁচে আছিস কী করে, তোর দিনরাত্রি কেমন

করে কাটছে।’ কিছু পরেই এই আড়ালটুকুও রাখেন না। বলেন : আজ কেবলই মনে হচ্ছে

এই যে বর্ষা, এ তো এক সন্ধ্যার বর্ষা নয়। এ যেন আমার সমস্ত জীবনের উপরে

সঙ্গিহীন বিরহসন্ধ্যার নিবিড় অন্ধকার ― তারই দিগদিগন্তরকে ঘিরে অশ্রান্ত

শ্রাবণের বর্ষণে প্রহরের পর প্রহর কেটে যাচ্ছে; আমার সমস্ত আকাশ ঝর ঝর

করে বলছে, ‛ কৈসে গোঙায়বি হরি বিনে দিন রাতিয়া ’।


কে এই ‛হরি’ রবীন্দ্রজীবনে? হয়তো-বা ভালোবেসে অবধি না পাওয়া নিজস্ব সত্তারই

রূপক তা। হয়ত বা ভালোবাসার ধন। জীবনের শেষ বেলায় এসে আর একবার ‛সিন্দুক’

থেকে এই গানটি তুলে এনে রবীন্দ্রনাথ সমর্পন করলেন ‛শেষের কবিতা’র অমিতকে।

অমিত এ পর্যন্ত কখন‌ও বিদেশী কবির কবিতা ধার করে, কখন‌ও নিবারণ

চক্রবর্তীর বকলমে লাবণ্যকে কবিতায় কবিতায় আপন মনের ঠিক কথাটি বলতে

চেষ্টা করেছে। এক বৃষ্টির দিনে মনে হলো, তাও যেন ঠিক কথাটি বলে ওঠা হয়নি

তার। তখন কথার অতিরিক্ত সত্য প্রকাশে সে সুরের কাছে হাত পাতে। লাবণ্যকে

জানায় : পরের কথাকে নিজের কথা করে তুলি। সুর দিতে পারতুমি যদি তবে সুর লাগিয়ে

বিদ্যাপতির বর্ষার গানটাকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করতুম ―

বিদ্যাপতি কহে কৈছে গোঙায়বি

হরি বিনে দিন রাতিয়া।


যাকে না হলে চলে না তাকে না পেয়ে কী করে দিনের পর দিন কাটবে, ঠিক এই কথাটার

সুর পাই কোথায়। উপরে চেয়ে কখনো বলি কথা দাও, কখনো বলি সুর দাও।


এইসময় দেখি পদাবলীর শব্দমোহ ছাড়িয়ে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ বহুকাল আগে।

পদাবলীর অঙ্গে জড়ানো কীর্তনের সুর ছাড়তে পারেননি তিনি যেন কখনই। তাই

আপনকথার সম্ভার রবীন্দ্রগান ক্ষণে ক্ষণে সেই সুর-খচিত হয়েছে। তবে তারও তো

একটা শুরুর সময় আছে। সেটি কবে ?



 
 
 

Comments


Subscribe to Site

Thanks for submitting!

© 2020 Bhaan Theatre | Designed by Capturegraphics.in
bottom of page