ক্ষতি হয়েছে সিনেমার
- Bhaan Magazine
- Sep 10, 2021
- 4 min read

অজন্তা সিনহা
তাঁর সিনেমা ছিল কবিতার মতোই সৎ, সুন্দর, স্বচ্ছ ও বলিষ্ঠ। কবি তো ছিলেনই তিনি। অত্যন্ত শক্তিশালী এক কবি ও আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা নির্মাতার মেলবন্ধন ঘটেছিল তাঁর মধ্যে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের বিচিত্র মানুষের যাপন টেনেছে তাঁকে বারবার। সেলুলয়েডে সেই জীবনযাপনকেই চিত্রিত করেছেন। শেষের কয়েকটি বছর খুব বেশি আলোচনায় ছিলেন না তিনি। তার কারণ শুধুই কি তাঁর অসুস্থতা ? বলতে দ্বিধা করা উচিত নয়, পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত যে ঘরানার ছবি নির্মাণ করতেন, সেটা দেখার দর্শক ও পরিবেশ দুইই ক্রমশ বিরল হয়ে পড়ছিল, বিরল হয়ে পড়েছে।

এমনকী আমরা, যারা তাঁর তৈরি সিনেমা দেখতে দেখতে সেলুলয়েডে একেবারে ভিন্নমাত্রার গল্প (নাকি কাব্য !) লেখার স্বতন্ত্র ধারাটি বুঝতে শিখলাম, তারাও কি ঠিক বুঝেছিলাম তাঁকে ? তিনি তো আমাদের সময়ের পরিচালক। আমরাও কি বলিনি, 'তিনি শুধু পুরস্কারপ্রাপ্তির জন্য সিনেমা বানান ? সাধারণ দর্শকের জন্য বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবি নয় !' ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতা প্রসঙ্গে যাবার আগে, এইটুকু স্বীকারোক্তি না করলে কালের কাছে অপরাধী থেকে যাব। সেই কাল, যা নির্মম ও কঠিন এক সত্যদ্রষ্টা। যার কাছে কিছুই লুকোনো থাকে না। আমরা, এই বাঙালি জাতি যে চিরকাল ভাবের ঘরে চুরি করে এসেছি, আমরা আদতে এক চরম পর্যায়ের আত্মপ্রবঞ্চক, সে কথা এই মহান পরিচালক সম্পর্কে লিখতে গিয়ে আরও একবার স্মরণে এলো।
আমার সাংবাদিক পেশায় আমি একবারই তাঁর মুখোমুখি হই। তার আগে বিভিন্ন ছবির প্রিমিয়ারে বা সাংবাদিক সম্মেলনে দূর থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়। বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তথাকথিত ভাবে খুব জনপ্রিয় মানুষ ছিলেন না, সেটা যেমন ঠিক ! তেমনই তাঁকে খুব দাম্ভিক ও নাক উঁচু বলে কেউ কেউ যে চিহ্নিত করার চেষ্টা করতো, সেটাও সর্বৈব মিথ্যে। তাঁর কাছে পৌঁছবার পর সহজেই অনুভব করি একথা। আদ্যন্ত শিক্ষিত, সভ্য, স্নেহপ্রবণ একজন মানুষ তিনি। এটা ঠিক মেধা ও শিক্ষার একটা ধারালো দিক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মধ্যে ছিল। আর আমি সেটা স্বীকার করে নিয়েই তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়াই, যথাসম্ভব হোমওয়ার্কের পর। আজও মনে আছে, সিনিয়র সিনেমা সাংবাদিক নির্মল ধরের কথা। উনি বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বহুকালের বন্ধু। নির্মলদা ওঁর সম্পর্কে নানা তথ্য দিয়ে আমাকে খুব সাহায্য করেন সেদিন। কোনও দিনই বিষয়ের বাইরে প্রশ্ন ক'রে গুণী মানুষজনকে উত্যক্ত করা আবার ধাতে ছিল না। এক্ষেত্রেও সেভাবেই তৈরি হয়ে গেলাম।
মজার কথা হলো, আমার এপয়েন্টমেন্ট যিনি করে দেন, তিনি সিনেমা জগতের কেউ নন, একজন তরুণ কবি। কবিতার সূত্রেই আমার সেই ভাইটি প্রায় নিয়মিত যেত পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের বাড়ি। এক ব্যস্ত বিকেলে তার সঙ্গেই পৌঁছে গেলাম ওঁর দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটে। আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধদেববাবুর আসন্ন মুক্তি প্রতীক্ষিত ছবি 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান' !
বহুকাল আগের কথা। যতদূর মনে পড়ছে, প্রথমেই আমরা কথা বলি, ছবির প্রেক্ষাপট বিষয়ে। সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের লেখা ছোট গল্পটিকে চিত্রনাট্যে রূপ দেন পরিচালক। লতি নামের এক কিশোরী, যার মা একজন পতিতা। মেয়েকে নিয়েও ব্যবসা করতে চায় সে। কিন্তু লতি চায় এক অন্য জীবন। মা তাকে এক প্রবীণ ধনীর সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়। লতি বিদ্রোহী হয় ও পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। সিনেমার গল্পের বিস্তারে না গিয়ে গল্প প্রসঙ্গে বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কথাই বলবো, "লতির লড়াইয়ের ইচ্ছেটাই আমাকে টেনেছিল। একটা অসম যুদ্ধ সে লড়তে চাইছে। প্রফুল্লবাবু প্রতিটি চরিত্রকে এমন রক্তমাংসের করে লিখেছেন এখানে…!"

সাহিত্যানির্ভর ছবিই বেশিরভাগ নির্মাণ করেছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "সাহিত্য হলো জীবনসম্পদের খনি। এমন অনেক যাপনের সন্ধান এখানে পাই, যা অভিনব, অজানা, বিচিত্র...সর্বোপরি মনস্তাত্বিক দিক থেকে খুব আকর্ষণীয়। ছবি তৈরি করার ফাঁকে স্টাডি করারও দারুণ একটা সুযোগ মেলে।" সেদিন কথায় কথায় তাঁর সাহিত্যপ্রীতি, গভীর ও ব্যাপ্ত পড়াশোনার এক অনন্যসাধারণ পরিচয় পেয়েছিলাম। কতটা সমৃদ্ধ হই, সেকথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। মনে পড়ছে, ঘন্টা কেটে গেছে। নির্ধারিত সময়ের কথা ভুলে বলে চলেছেন তিনি। নিজের জ্ঞানের পরিধি জানাবার জন্য নয়। অকৃত্রিম আবেগে। আর সঙ্গে খুব সুন্দর করে চা-পান। কথাটার উল্লেখ এই জন্য করলাম, নিজের মতোই আমাকেও চা-বিলাসী পেয়ে শিশুর মতো খুশি হতে দেখেছিলাম ওঁকে। সেখানেও পরিপাটি এক শিল্পরস যেন ঘিরেছিল তাঁকে।
ছবিতে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, তাপস পাল, প্রদীপ মুখার্জি, সুদীপ্তা চক্রবর্তী, জুন মালিয়ার মতো তারকা অভিনেতা ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নিয়ে নয়। আমি কথা বলেছিলাম মুখ্যত দুজনকে নিয়ে, এক, লতির চরিত্রে সমতা দাস। দুই, নটবর পালধির চরিত্রে রামগোপাল বাজাজ। সমতা সেই সময় বাংলা টেলিভিশনের এক অতি উজ্জ্বল মুখ। লতির জন্য তাঁকে নির্বাচন যে একশোভাগ সঠিক ছিল, একথা বলার সময় বুদ্ধবাবুর মধ্যে এক অসাধারণ উচ্ছ্বাস লক্ষ্য করেছিলাম। একজন নতুন অভিনেতাকে গড়েপিঠে নেওয়ার মধ্যে এক যথার্থ সৃজনশীল পরিচালকের যে তৃপ্তিটা হয়, সেটা লুকোননি তিনি সেদিন। বলেছিলেন, "সমতা হতাশ করেনি আমায়। অত্যন্ত ক্ষমতাশালী এবং বাধ্য। পরিশ্রম ও প্রতিভায় অনেক দূর যাবে ও দেখবেন !" সমতা এমন এক ব্রেক পাওয়ার পর কতদূর গেছে বা যায়নি, সে আলোচনা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। তবে, 'মন্দ মেয়ের উপাখ্যান'-এ তিনি আমাদের আশাহত করেননি, সেটা নিশ্চিতরূপে বলা যায়। ছবির জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির একজন অংশীদার তিনিও।

রামগোপাল বাজাজকে নিয়ে আমি ঠিক বিপরীত প্রশ্ন করেছিলাম। আমাদের এখানে কি চরিত্রাভিনেতার অভাব ? ওঁকেই কেন ভাবলেন পরিচালক ! এ প্রশ্নের জবাবে ওঁর বক্তব্য, "আমি এর আগেও ভিনরাজ্যের অভিনেতাদের নিয়ে কাজ করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই গর্বিত করেছে আমায়। রামগোপাল একজন অত্যন্ত শক্তিশালী ও অভিজ্ঞ থিয়েটার ব্যক্তিত্ব। হিন্দিছবিতে আমি ওঁর কাজ দেখেছি। নটবর পালধি চরিত্রে ওঁকেই আমার সবচেয়ে উপযুক্ত মনে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় কথা, এমন একজনকে চাইছিলাম, যে নিজেকে প্রবলভাবে ভাঙতে সক্ষম। আমি একেবারেই টিপিক্যাল ভিলেন চাইনি।" পরবর্তীতে ওঁর কথার সত্যতা প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার প্রাক্তন অধিকর্তা রামগোপাল বাজাজ নটবরকে জীবন্ত করে তোলেন মেধা, প্রতিভা, শিক্ষা ও চেতনার গুণে ।
ছবির সংগীত, পোস্টার ডিজাইন থেকে অন্যান্য দিক, সব নিয়েই কথা হয় সেদিন। প্রত্যেকটি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ও পারদর্শিতা নতজানু করবে আমার মতো এক তুচ্ছ সাংবাদিককে, সেটাই স্বাভাবিক। এরইসঙ্গে বিশ্ব সিনেমা বিষয়ে তাঁর পড়াশোনা প্রায় গবেষণার স্তরে। সেই সময়, যখন সিনেমার বহির্বিশ্ব মানে শুধুমাত্র কয়েকটি উৎসব। সেদিন ওঁর এই তথ্যভান্ডারের খবর মুষ্টিমেয়র কাছেই থেকে গেছে। আপামর মানুষের দরবারে পৌঁছয়নি, সে আমাদেরই ব্যর্থতা। আমরা যে চিরকাল সস্তা বিনোদনে বিশ্বাসী, সিনেমা বাণিজ্যের চলাফেরার মানচিত্রটা সে কথাই বলে।
সেই সস্তা লোভ ও লাভের তাগিদেই দর্শক ভালো সিনেমা পরিত্যাগ করে অবাস্তব ও মেকি রঙে রঙিন সিনেমা দেখতে হলে ছোটে। এই আজ-কাল-পরশুর গল্পে প্রায়ই আমরা এই জাতীয় শিক্ষিত পরিচালকদের দোষ দিই এই বলে যে, ওঁরাই আসলে জনমোহিনী ছবি বানাতে পারেন না । তাই ওঁদের ছবি দর্শকধন্য নয়। কিন্তু মনে মনে সত্যিটা সবাই জানি। একটি চক্র, যারা শিক্ষা, প্রতিভা, মেধা, সুস্থ ও জীবনধর্মী চিন্তার একেবারে বিপরীতে হেঁটে শুধু নিজেদের মুনাফা দেখে। এদের স্বার্থে একশ্রেণীর প্রযোজক, পরিচালক, ডিস্ট্রিবিউটর থেকে মিডিয়া কাজ করে। এরাই সুচতুর ভাবে আম জনতার মাথাটা সিনেমা সম্পর্কে গুলিয়ে দেয়। আক্ষেপ, এতে ক্ষতিটা সেইসব সৃজনশীল মানুষের হয়নি। তাঁরা সৃষ্টিসুখে তাঁদের কাজ করে গেছেন। নিজেদের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন। ক্ষতি হয়েছে সিনেমার। আজ যে বিশ্বের, এমনকী এশিয়ারও ছোট ছোট দেশগুলি ভালো সিনেমা নির্মাণে আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে গেছে, তার কারণ এটাই।
Comments