বিজন ভট্টাচার্য : যার নাটকই জীবন, জীবনই নাটক - মনে করালেন দেবহূতি সরকার
- Avijit Mitra
- Jul 8, 2021
- 4 min read
Updated: Jul 10, 2021

লেখক : দেবহূতি সরকার
‘নবান্ন’, ‘দেবীগর্জন’, ‘জীয়নকণ্যা’ র মত একাধিক নাটকে বাংলা নাটকের ভাষাকে বলা যেতে
পারে বদলে দিয়েছিলেন তিনি। গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম প্রতিভূ নাটক ‘নবান্ন’এ গ্রাম
বাংলার নিরন্ন মানুষের জীবনের নাট্যরূপ দান করেছিলেন শুধু নয়– সারাজীবনই তিনি খেটে খাওয়া
মানুষের জীবনের দলিল রচনা করে গেছেন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য।
রচিত নাটকের মতোই বিজনের জীবনও বিচিত্রপথগামী। কয়েকটি আশ্চর্য সাক্ষাৎকার থেকে
আমরা বিজনের সেই ঘটনাবহুল জীবনের গল্প জানতে পারি। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলাদেশের
ফরিদপুর জেলার খানখানাপুর গ্রামে, ১৯১৫ মতান্তরে ১৯১৭ সালের ১৭ জুলাই। তাঁর পিতা
ক্ষীরোদচন্দ্র (মতান্তরে) ক্ষীরোদবিহারী ভট্টাচার্য ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মা সুবর্ণপ্রভা
ছিলেন বিখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদারের বোন। বিজনের ছাত্রজীবনের প্রথম দশবছর
খানখানাপুরেই কাটে। তারপর পিতার কর্মসূত্রে বসিরহাট, সাতক্ষীরা, মেদিনীপুর, আড়বেলে
ইত্যাদি নানা জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন আড়বেলিয়া জে. ডি.
হাইস্কুল থেকে।

ছবি : গুগল
নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য
বিজনের ছোটবেলায় বাড়িতেও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল। বাবা ছিলেন সাহিত্য-সঙ্গীতপ্রেমী মানুষ।
বাড়ীতে শেক্সপিয়ারের চর্চা ছিলো, এমনকি ঘরোয়া অভিনয়ও হতো। বাবা, মা, ভাই, বোনেদের
সঙ্গে বিজনও অংশ নিতেন অভিনয়ে। দশ বছর বয়েসে যখন মানেও বুঝতেন না ভালো করে , তখন
থেকেই শেক্সপিয়ার মুখস্থ বলতে পারতেন। পরে যখন মানে বুঝে পড়েছেন তখন তেমন আকৃষ্ট হন
নি। তাঁকে আকর্ষণ করতো গ্রামবাংলার লোকনাট্যের জগৎ। পুজোর সময় মন দিয়ে শুনতেন
গ্রাম্য থিয়েটার, যাত্রাপালা, কথকথা, ঢপের গান। নিজের কথকথা করতেন তখন।
গ্রামের সাধারণ অতিদরিদ্র নিম্নবর্গের মানুষের জীবন যাপন, তাদের ভাষা, জীবীকা, তাদের
আমোদ প্রমোদের ধরণ এসবই মারাত্মক আকর্ষণ করতো বিজনকে। বাড়ির যাবতীর শাসন, নিষেধ
অমান্য করে জেলেপাড়া, কুমোড়পাড়ায় পড়ে থাকতেন তিনি। মিশতেন টুনো, মালো, সাপুড়েদের সঙ্গে।
আউল-বাউল-ফকিরদের আখড়ায় তাঁর ছিলো প্রায়ই আসা যাওয়া। এইসব লোকায়ত মানুষের
জীবনের সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না দৈনন্দিনের জীবন যুদ্ধের সঙ্গে মিশে ছিলো তাঁর ছোটবেলা।
কলকাতায় চলে আসার পরেও তিনি যোগাযোগ রেখে গেছিলেন এই মানুষদের সঙ্গে। বিজনের
নাটকজুড়ে যেসব চরিত্রেরা ঘুরে বেড়ায় তারা আসলে বিজনের চোখে দেখা এই জীবন্ত মানুষগুলির
শিল্পরূপ বললে ভুল হয় না।

ছবি : গুগল
সেই ১২-১৩ বছর বয়স থেকেই বিজন সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে।
অসহযোগ, আইন অমান্য ইত্যাদি আন্দোলনের সময় তিনি নান জায়গায় ঘুরে আন্দোলন সংগঠন
করেছেন, বিদেশী দ্রব্য বর্জন, বিলিতি জিনিস পুড়িয়ে ফেলে প্রতিবাদ – এসব কাজও জোর কদমে
করেছেন তিনি। এর পরবর্তীতে রাজনৈতিক মতাদর্শের বদল ঘটলেও আজীবন বিজন ছিলেন এক
আদ্যন্ত রাজনীতি সচেতন মানুষ। তাঁর প্রতিটি নাটকেই তার প্রকাশ ঘটেছে।
১৯৩০ সালে বিজন কলকাতায় চলে আসেন এবং এই শহরের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে যুক্ত
হন। বোর্ডিং এ থেকে আশুতোষে পড়ার সময়ে অভিনয় করেন ‘চিরকুমার সভা’ ও ‘শেষরক্ষা’ নাটকে।
তাঁর গান ও আবৃত্তি শুনে নজরুল বিজনকে আহ্বান করেন তাঁর সঙ্গে যোগ দিতে। এই সময়ই লবণ-
আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয় এবং বিজন সেই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন, ফলে বি.এ. পড়াতেও
তাঁর ছেদ ঘটে। জনহিতকর কাজের টানে কলকাতায় আসার পর তিনি দক্ষিণেশ্বর বেলুড়মঠেও
যাতায়াত করতেন। ১৯৩৪-১৯৩৫ সালে বিজন যোগ দেন ছাত্র ফেডারেশনে। তখন বিজন ও তাঁর
বন্ধুদের ‘অনামী চক্র’ নামে একটা সাহিত্য আড্ডা ছিলো , প্রতি শনিবার সেখানে আসতেন মন্মথ
সান্যাল, সুবোধ ঘোষ, স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য প্রমুখেরা। তিরিশের দশকের শেষদিকে বিজন
কিছুদিন আনন্দবাজার পত্রিকায় বছরখানেক চাকরি করে, ৪০-৪১ সাল নাগাদ সে চাকরি চেড়েও
দেন। এই সময়েই শুরু হয় তাঁর গল্প লেখা। একের পর এক গল্প প্রকাশিত হত থাকে
‘আনন্দবাজার’, ‘অরণি’, ‘অগ্রণি’ ইত্যাদি পত্রিকায়। সত্যেন মজুমদার সম্পাদিত ‘অরণি’
পত্রিকার ‘সহযাত্রী’ ছদ্মনামে অন্যান্য লেখাও লিখতেন তিনি।
তিরিশের দশকের শেষ দিক থেকে সচেতন ভাবে মার্কসীয় দর্শনচর্চা শুরু করেন বিজন।
আনন্দবাজার পত্রিকার রেবতী বর্মণের লেখা মার্কবাদ বিষয়ক একটি বইএর বিজনের লেখা
সমালোচনা পড়ে মুজফফর আহমেদ তাঁকে ডেকে পাঠান। এরই মাঝে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন
বিজন। ১৯৩৯ সালে ঝোড়ো জীবনযাপনের ফল হিসেবে টি.বি. ধরা পরে তাঁর। ঢেঁকি যেমন স্বর্গে
গেলেও ধান ভাঙে তেমনই অসুস্থতাকালীন হসপিটাল জীবনেও থেমে থাকেনি বিজনের প্রতিবাদ ও
নাট্যচর্চা। এক বছর যাদবপুর টি.বি. হাসপাতালে থাকার সময় হাসপাতালের ভেতরেই গড়ে তোলেন
‘রিক্রিয়েশন ক্লাব’ আর ‘পেশেন্টস ইউনিয়ন’। রোগীদের ভালো পথ্যের দাবীতে হাসপাতাল
কতৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন যেমন গড়ে তোলেন তেমনই আবার রোগীদের দিয়ে নাটকের
অভিনয়ও করান, নিজেও অভিনয় করেন। দুটি নাটক- ‘চিকিৎসাসংকট’ আর ‘বিরিঞ্চিবাবা’।
বিজনের কথায় “ঐখানেই প্রথম নাটক করি”। এই নাটক করাতে গিয়ে ছেলে এবং মেয়েরা যাতে
একসঙ্গে অভিনয় করতে পারে তাই কতৃপক্ষের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে শেষ পর্যন্ত অনুমতিও
জোগাড় করেছিলেন তিনি।
১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির হোলটাইমার হিসেবে যোগ দেন বিজন। সেই উত্তাল সময়ে
একদিকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কমিউনিস্ট পার্টি ফ্যাসিবিরোধী
জনযুদ্ধের লাইন গ্রহণ করে। সক্রিয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্থাপিত হয় ‘ফ্যাসী বিরোধী
লেখক শিল্পী সঙ্ঘ’। বিজন ছিলেন তার একনিষ্ঠ সংগঠন থেকেই ১৯৪৩ সালের মে মাসে জন্ম হয়
‘ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ’( আই পি টি এ) –এর। পার্টি থেকে নতুন নাটক লেখার জন্য তরুণ
লেখকদের মধ্যে প্রচার চালানো হচ্ছিলো। এই প্রচারে সাড়া দিয়ে বিজন লিখলেন ‘আগুন’।
মন্বন্তরের প্রথম পর্যায়ে খাদ্য বণ্টন ব্যবস্থার অসাম্য নিয়ে লেখা এই নাটক। নাটকটি
‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনায় ‘আগুন’ প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৯৪৩
সালেই নাট্যভারতী মঞ্চে। ১৯৪৩ এই বিজন রচনা করলেন ‘জবানবন্দী’ নাটক, প্রকাশিত হলো
‘অরণিতে’, আই পি টি এ-র প্রযোজনায় স্টার থিয়েটারে অভিনীত হলো ১৯৪৪সালে। এর পরেই
বিজন লিখলেন তাঁর যুগান্তকারী নাটক ‘নবান্ন’। মাত্র ৯দিনে। মন্বন্তরের রূঢ় বাস্তবের জীবন্ত
দলিল এই নাটক, মঞ্চস্থ হলো ১৯৪৪এর ২৪ অক্টোবর শ্রীরঙ্গম মঞ্চে, গণনাট্য সঙ্ঘের
প্রযোজনায়। বিজন নিজেও অসামান্য অভিনয় করলেন প্রধান সমাদ্দারের চরিত্রে। বাংলা
নাটকের ধারায় প্রতিবাদী, শ্রেণি সংগ্রাম সচেতন নাটকের এর নতুন ধারার সূত্রপাত হল
‘নবান্ন’এর মাধ্যমে।
এরপর বেশ কিছুদিন বিজনের সৃষ্টিকর্মে ছেদ পরে। তার কারণ ১৯৪৬ এ পার্টির সঙ্গে ঘটা
মতাদর্শগত সংঘাত। এই সংঘাতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। সংসারীও হন এই ১৯৪৬এই।
বিবাহ করেন মহাশ্বেতা দেবীকে, ১৯৪৮ জন্মালেন একমাত্র সন্তান নবারুণ। পার্টি ও আই পি টি
এ-র সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ গত দূরত্ব আর কাটেনি বরং বাড়তেই থাকে, ’৪৮ সালে গণনাট্য
সঙ্ঘ ত্যাগ করেন বিজন।
‘জীয়নকন্যা’ গীতিনাট্যটি লেখা হয়েছিলো দেশভাগের আশঙ্কায়, মাত্র ১৮ দিনে। এই নাটকটি
রেডিও প্রোডাকশন হয় ১৯৪৭। আর ’৫০ একবার মাত্র মঞ্চ প্রযোজনা হয়। বিজন সেই
প্রযোজনায় লোকনাট্যের ধরণকে কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। শ্রমিক আন্দোলনের ওপর ভিত্তি
করে এইসময়েই লিখছেন ‘অবরোধ’ নাটক। লিখছেন ‘মরাচাঁদ’ একাঙ্ক।জীবিকার প্রয়োজনে দুবছর
বম্বের শিল্পজগতের সঙ্গে যুক্ত হলেও বিজনের স্বাধীন মন সেখানে প্রাণের আরাম পায় নি, ফলে
আবারও কোলকাতায়।
কলকাতায় ফিরে বিজন তৈরি করলেন ‘ক্যালকাটা থিয়েটার’ নামের নাট্য সংস্থা। পরবর্তী কুড়ি
বছর তিনি ছিলেন এই থিয়েটারের নাট্যকার, পরিচালক, প্রযোজক আবার অভিনয়ও করেছেন।
মঞ্চস্থ করেছেন একের পর এক নাটক ‘কলঙ্ক’, ‘মরাচাঁদ’, ‘গোত্রান্তর’, ‘ছায়াপথ’,
‘মাস্টারমশাই’, ‘দেবীগর্জন’, ‘গর্ভবতী জননী’। শোষিত, নিপিড়িত, সমাজের নিম্নবর্গের মানুষের
অধিকার আদায় করে নেওয়ার লড়াই-এর কথাই শিল্পীর নিজস্ব ভাষায় নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে
এইসব নাটকে। ‘দেবীগর্জন’ লেখার সময় থেকেই গ্রেট মাদারের তত্ত্ব বিশেষভাবে স্থান
পেয়েছিলো তাঁর মনে।
‘ক্যালকাটা থিয়েটর’ ছেড়ে ১৯৭০ সালে তিনি গড়ে তুললেন ‘কবচকুণ্ডল’ নাট্যদল। প্রযোজনা
করলেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘আজ বসন্ত’, ‘চলো সাগরে’। বিজনের এই পর্বের নাটকে মার্কসীয় চেতনার
পাশাপাশি লোকায়ত ধর্ম, হিন্দু ধর্ম, ভারতীয় ও লোকায়ত দর্শন প্রকটভাবে উঠে এসেছে। তবে
এক অস্তিবাদী জীবন-সংগ্রাম চেতনার দায়িত্ব শেষ অবধি পালন করে গেছেন নাট্যকার বিজন।
নাটকের সঙ্গে বিজনের আত্মিক যোগ আক্ষরিক অর্থেই আমৃত্যু- ১৯৭৮ সালের ১৯ জানুয়ারী
মারা যাচ্ছেন তিনি, আর তার আগের দিন রাতেও অভিনয় করছেন ‘মরাচাঁদ’ নাটকে। আজীবন বিজন
যা বিশ্বাস করে এসছেন তাই বলতে চেয়েছেন তাঁর নাটকে। তাঁর যাপিত জীবন আর তাঁর
নাট্যজীবনকে আলাদা করে দেখতে গেলে তাই ভুল থেকে যাবে সেই দেখায়। বিজন ভাট্টাচার্যের
ক্ষেত্রে তাঁর নাটকই জীবন, জীবনই নাটক।
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Kommentare