পাঠশালার কথা
- Bhaan Magazine
- Sep 10, 2021
- 10 min read
Updated: Sep 12, 2021

আবীর কর
ষোড়শ শতকে জয়ানন্দের 'চৈতন্যমঙ্গল' এ নদীয়া খন্ডে শ্রীহট্টের বর্ণনায় আছে-
'শ্রীহট্ট দেশের মধ্যে জয়পুর গ্ৰাম।
সর্ব্ব সুখময় স্থান ক্ষিতি অনুপাম।।
দীঘি সরোবর কূপ তড়াগ সোপান।
দেউল দেহারা মঠ নানা পুষ্পোদ্যান।।
...
নাটশাল পাঠশাল চৌখন্ডী বাঙ্গালী।
ধ্বজ কল হংস পারাবত করে কেলি।।
আবার নদীয়ার বর্ণনাতে আছে- 'নাটশাল পাঠশাল দীঘি সরোবর...।' প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য 'চৈতন্যমঙ্গল' এ চৈতন্যের হাতেখড়ি, কর্ণবেধ ও উপনয়নের বর্ণনার পাশাপাশি সুদর্শন পন্ডিত, বিষ্ণু পন্ডিত, গঙ্গাদাস পন্ডিতের প্রসঙ্গ পেড়েছেন কবি জয়ানন্দ। তবে চৈতন্যদেবের শিক্ষার বর্ণনায় যে ছবি মেলে তার সঙ্গে টোলের শিক্ষার মিল যথেষ্ট।
এবার আসা যাক, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল' এর ধনপতি আখ্যানে, সেও ষোড়শ শতকের রচনা। শ্রীমন্তের বিদ্যাশিক্ষার প্রসঙ্গ এসেছে সেখানে বিস্তারিত ভাবে। জনার্দন ওঝার কাছে ধনপতি পুত্রের শিক্ষা লাভের ছবিতে আছে-
'পড়য়ে সাধুর বালা প্রথমে আঠার ফলা
ক খ আক্ষ আস্ক বানান।
গুরুবাক্যে দিয়া কর্ণ চিনিল অনেক বর্ণ
পড়িল শুনিল সুলক্ষণ।।
দ্বিজ মাধবের 'মঙ্গলচন্ডীর গীত' এ শ্রীমন্তের বিদ্যাশিক্ষার বর্ণনায় আছে-
'চন্ডিকার ব্রত হেতু পড়িল সকল ধাতু
দীপিকায়ে জানিল কারণ
ষত্ব ণত্ব জ্ঞান হয়ে সংস্কতে কথা কহে
পারগ হইল ব্যাকরণ।'
--- শ্রীমন্ত ধনীর দুলাল, তার বাবার নাম ধনপতি, সওদাগর জাত, ফলস্বরূপ তার পুত্র শ্রীমন্ত সংস্কৃতজ্ঞ হয়ে আরও গণ্যমান্যদের পরিমন্ডলে স্থানলাভে প্রয়াসী হবে, এ স্বাভাবিক। উল্টোদিকে কালকেতুর পাঁচ বছরের পদার্পণ কালে তারও কান বেঁধানো (কর্ণবেধ) হয়, তবে শিক্ষা নয় শিকারে অভিষেক ঘটানোর জন্য। বর্ণনায় আছে- 'পঞ্চম বরিষে কৈল কর্ণের বেধন'। তারপর-
'গণকে আনিয়া ঘরে শুভদিন শুভবারে
ধনু দিল ব্যাধসুত-করে।'
-- এরপর চন্ডীর কৃপায় কালকেতুর রত্নলাভ, গুজরাট নগরীর পত্তন। সেই নয়া রাজপাট গুজরাটে পাঠশালার উল্লেখ না থাকলেও মক্তবের কথা আছে। উল্লেখ্য- 'যত শিশু মুসলমান/তুলিল মক্তবখান।' সেই সময়কালে মন্দির সংলগ্ন নাটশালা, পাঠশালার মতোই মসজিদের সাথে মক্তবের যোগ ছিল।
এরপর আঠারো শতকের পুঁথি বিপ্রদাস পিপলাই -এর 'মনসাবিজয়' -এ পাঠশালার উল্লেখ আছে স্পষ্ট ভাবে। উল্লেখ্য-
'ছোট জন নহে চান্দ রাজ ভোগে ভোলা।
লক্ষ লক্ষ লোক যার আছে পাঠশালা।।
নানা দেশে পাঠসব, নানা দেশে ঘর।
সোমাই পন্ডিত পাঠ পড়ায় নিরন্তর।।
কেহ কাব্য শাস্ত্র পড়ে, কেহ ব্যাকরণ।
সব হইতে যোগ্য চান্দর পুত্র ছয়জন।।
একদিনে ছয় ভাই পড়ে পাঠশালা।
পড়িতে পড়িতে হইল দুপ্রহর বেলা।।'
-- এরপর লখিন্দরের শিক্ষালাভ সম্পর্কে বক্তব্য-
'লখাইর অনুমতি পায়্যা রাজরানি।
সোমাই পন্ডিত দ্বিজে ডাক দিয়া আনি।।
সনকা বলেন দ্বিজ না করিহ হেলা।
যত্নে পড়াইহ মোর লখিন্দর বালা।।
শুনিয়া হরিষ দ্বিজ রানির বচনে।
লখাইর হাতেখড়ি দিল শুভক্ষণে।।'
- এরপর বিস্তারিত ভাবে লখিন্দরের মেধা ও স্বল্পসময়ে শিক্ষার্জনের বর্ণনা দিয়েছেন কবি। আঠারো শতকের আর এক কবি বিষ্ণুপাল, তার 'মনসামঙ্গল' গ্ৰন্থেও পাঠশালার উল্লেখ করেছেন-
'রাজপুত্র মুনিপুত্র পড়ে পাটশালে।' উল্লেখ্য 'মনসামঙ্গল' এ পাঠশালার পাশাপাশি মক্তবের উল্লেখও আছে। আর বিপ্রদাসের সনকা হলেন সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে উদ্বিগ্না মায়েদের মধ্যে সম্ভবত প্রথম অভিভাবক স্থানীয়।
সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত আলাওলের 'পদ্মাবতী'তে আছে রাজকন্যা পদ্মাবতীর পড়াশোনার প্রসঙ্গ। সেই বর্ণনায় পাই-
'পঞ্চম বৎসরে যদি হৈল রাজবালা।
পড়িতে গুরুর স্থানে দিল ছাত্রশালা।।
মহান পন্ডিত হৈল কন্যা গুণবান।
-- অর্থাৎ সপ্তদশ শতকে মেয়েদের পড়াশোনার এক দৃষ্টান্তমূলক ছবি মিলছে ।
শুধু তাই নয়, সতেরো-আঠারো শতকে লিপি করা দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত 'লায়লী-মজনু' কাব্যে পাঠশালার যে ছবি মেলের তা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার স্কুলকেও হার মানায়। উল্লেখ আছে-
'সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি।
গুরুপদ ভজিয়া পড়এ প্রতিনিধি।।
সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।
একস্থানে সভানে পড়এ আনন্দিত।।
সেই পাঠশালাতে পড়এ কত বালা।
সুচরিতা সুললিতা নির্ম্মলা উজ্জ্বলা।।
---- এই পাঠশালায় একই সঙ্গে পড়ে আমির পুত্র কয়েস আর বণিক কন্যা লায়লী। শুধু তাই নয়, সতেরো-আঠারো শতকে লিপি করা দৌলত উজির বাহরাম খাঁ রচিত 'লায়লী-মজনু' কাব্যে পাঠশালার যে ছবি মেলের তা আজকের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার স্কুলকেও হার মানায়। উল্লেখ আছে-
'সেই উদ্যানে গিয়া কএস সুমতি।
গুরুপদ ভজিয়া পড়এ প্রতিনিধি।।
সুন্দর বালকগণ অতি সুরচিত।
একস্থানে সভানে পড়এ আনন্দিত।।
সেই পাঠশালাতে পড়এ কত বালা।
সুচরিতা সুললিতা নির্ম্মলা উজ্জ্বলা।।
---- কো-এডুকেশনের প্রথম দৃষ্টান্ত হতে পারে এই আখ্যান সম্বলিত চিত্র। এই পাঠশালায় একই সঙ্গে পড়ে আমির পুত্র কয়েস আর বণিক কন্যা লায়লী। এই পাঠশালে পড়াকালীন তাদের প্রেমে পড়া, দৌলত উজির লিখছেন-
'শাস্ত্র পাঠ মুখ হন্তে থুইল সত্বর।
প্রেম পাঠ লেখিলেন্ত হৃদয় অন্তর।। ...
যেই দিন পাঠশালে মিলন না হএ।
কএস চলিয়া যায় কন্যার আলএ।। '
--- এরপর আমির-পুত্র কয়েস/কএস যখন লায়লীর প্রেমে মজনু তথা পাগল। তখন লায়লীর মায়ের তদন্তে ধরা পড়ছে, যত নষ্টের গোড়া ঐ পাঠশালা। তাই উদ্বিগ্ন মায়ের কড়া নির্দেশ-
'আজি হন্তে তেজহ চৌআড়ি পাঠশাল।
কুলের মহিমা নিজ রাখহ সামাল।।'
কিন্তু তারপরও আটকে রাখা যাচ্ছে না মেয়েকে, কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার সেই পাঠশালাতেই দেখা হচ্ছে তাদের-
'চলি গেল শীঘ্র গতি ভাবক ভাবিনী।
পাঠশালে দোহান মিলন হৈল পুনি।।'
--- যদিও শেষপর্যন্ত তাদের প্রেম পরিনয়ে আবদ্ধ হলোনা, সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু আঠারো শতকের একটি আখ্যানে আমরা ছেলেমেয়েদের একই পাঠশালে পড়ার নজির ও তার ফলস্বরূপ প্রেমে পড়ার যে নিদর্শন পেলাম, তা তো একেবারে এই সময়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিকতম ঘটনা বলে মনে হয়।
পাঠশালার শিক্ষায় হিন্দু ও মুসলমানরা একই সঙ্গে পড়াশোনা করতো। মূলত গ্রামের মন্দিরে আটচালায় বা ধনাঢ্য ব্যক্তির বৈঠকখানা, বারান্দা বা রোয়াকে পাঠশালা আয়োজিত হতো। দু-একটি স্থলে ব্যতিক্রম থাকলেও শিক্ষার্থীরা অধিকাংশই ছিল ছাত্র। ছাত্রের বাড়ির 'সিধা' থেকেই পন্ডিতমশায়ের সংসার নির্বাহ হতো। নগদ মূল্যের চেয়ে বেশী ছিল কলাটা, মুলোটা এমন কি অবস্থাপন্ন ছাত্রদের বাড়ির চাল,ডাল, পুকুরের মাছ আসতো পণ্ডিতমশায়ের জন্য। উনিশ শতকেও পাঠশালার প্রসার ছিল যথেষ্ট। পরমেশ আচার্য তার 'বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা' গ্রন্থে, 'এ্যাডাম রিপোর্ট' সম্পর্কে জানাচ্ছেন- 'দেশজ পাঠশালা শিক্ষা সম্পর্কে সরেজমিন তদন্ত করে উইলিয়াম এ্যাডাম ১৮৩৫, ১৮৩৬ ও ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে তিনটি বিস্তারিত প্রতিবেদন পেশ করেন শিক্ষা কমিটির কাছে। তিনি জানাচ্ছেন যে, তখন বাংলা ও বিহারের দেড় লক্ষ গ্রামের বেশিরভাগ গ্রামে একটি করে পাঠশালা ছিল। তাঁর মতে তখন এক লক্ষ দেশজ পাঠশালা ছিল গরিব শ্রেণির শিশুদের মাতৃভাষায় লেখা, পড়া আর অঙ্ক শেখার জন্য।' এড্যাম রিপোর্ট থেকে জানা যায় পাঠশালা শিক্ষা ছিল স্বতন্ত্র শিক্ষা, এর সঙ্গে টোল বা চতুষ্পাঠী শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। পাঠশালার শিক্ষার বিষয় ছিল বর্ণপরিচয়, বানান শিক্ষা, প্রাথমিক গণিত, ব্যবহারিক জীবনে প্রয়োজনীয় হিসেবের জন্য শুভঙ্করী-আর্যা।
সতেরো শতক থেকে উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাঠশালার ভূমিকা বাংলা ও বাঙালির জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রথম শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট ১৮৮৪'তে জানাচ্ছে, ১৮৮১-৮২ তে পঞ্চাশ হাজার পাঠশালাকে শিক্ষা বিভাগের আওতায় আনা হয়েছে। যদিও পাঠশালার পরিবর্তে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই। বিদ্যাসাগর মহাশয় দক্ষিণবঙ্গে যে কুড়িটি আদর্শ বিদ্যালয় বা মডেল স্কুল স্থাপন করছেন তার সময়কাল....... বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনের সময়কাল। যদিও তারপরও দীর্ঘ সময়কাল জুড়ে বিদ্যালয়ের মধ্যেও পাঠশালার ধরন-ধারন বজায় ছিল। বিদ্যাসাগর যে বিদ্যালয় স্থাপন করছেন সেখানেও শিক্ষক নিয়োগ ছাড়া বাকিটা ছিল পাঠশালার বৈশিষ্ট্য। বিদ্যালয় থেকে পাঠশালার গন্ধ মুছতে অনেক অনেক দিন সময় লেগেছে। এমনকি স্বাধীনতা উত্তরকালেও কোনো কোনো পাঠদানে পাঠশালার রীতিনীতি বজায় ছিল পাঠশালায়-পড়া মাস্টারমশাইয়ের আনুকূল্যে।
পাঠশালা সম্পর্কে নানান তথ্য উঠে আসে নানা খ্যাতজনের লেখায় স্মৃতি-রেখায়। আগ্ৰহী পাঠক দেখতে পারেন- 'সেকালের শিক্ষা/উজ্জ্বল উদ্ধার, সঙ্কলন-সম্পাদনা- অপূর্ব সাহা, আলাপ প্রকাশনী।' উক্ত সঙ্কলন-গ্ৰন্থ থেকে পাঠকের দরবারে রাখা যাক সেকালীন পাঠশালার কিছু অভিনব চিত্র। অক্টোবর ১৮৯৫, 'দাসী' পত্রিকায় রাসবিহারী সেন তার 'সেকালের পাঠশালা' রচনায় সেই সময়ের পাঠশালার শাস্তি বিষয়ে 'মনোজ্ঞ' বর্ণনা দিয়েছেন। একথা তো অনেকেরই জানা যে আজ ছাত্রছাত্রীদের কোনরূপ শাস্তি দেওয়া চলেনা এবং তুলনায় সেকালে শাস্তি ছিল চরম কড়া। শুধুমাত্র লাঠিষ্যোধির সাহায্যেই কত কত পন্ডিত অনায়াসে ছাত্রদের শায়েস্তা করেছেন এবং শিক্ষিতও করেছেন। এখন যেমন স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের হাজিরার বিষয়টি তেমন কড়া নয়। কোথাও কোথাও নূন্যতম উপস্থিতির হার থাকলেও, সেও খুব নরম গোছের। তা সেকালীন পাঠশালায় ছাত্রদের গরহাজিরাকে মোটেই হাল্কাভাবে নেওয়া হতোনা। কে আসছে, কে আসছে না, এবিষয়ে কড়া নজর থাকতো মাস্টরমশায়ের। অনুপস্থিতির কারণও ঐ সময়ে সংশ্লিষ্ট ছাত্রের যথাযথ অবস্থান নজরে রাখার জন্য মাস্টারমশায়ের নিজস্ব টিম ছিল, আর সেই টিম নিজেদের এহেন কাজে চরম আন্তরিকতার সঙ্গে নিজেদের উজাড় করে দিত। পাঠশালায় একজন থাকতো 'সর্দার-পোড়ো', সে মাস্টারমশায়ের সহকারী, অবশ্যই তাকে পড়াশোনায় ভালো হতে হতো, কেননা অনেক সময় পাঠশালার পাঠে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হতো। পাঠশালার নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায়ের ক্ষেত্রেও 'সর্দার-পোড়ো'র ভূমিকা ছিল প্রবল। আজকের দিনে ক্লাস-মনিটরের সঙ্গে যা তুলনীয়। অনেক সময় বেয়াড়া বিশৃঙ্খল ছেলেকে শায়েস্তা করার গুরুদায়িত্ব নিতে হতো 'সর্দার-পোড়ো' দের। তবে যে কোনো কারণে যে কোনো বালকের শাস্তিদানের বিষয়টি বাকি বালকদের কাছে যে বেশ উপভোগ্য, তা সবকালেই সমান সত্যি। রাসবিহারী সেন মহাশয় তার রচনায় সেকালের শাস্তির একখানি ছবি ছড়ায় বর্ণনা করেছেন-
'গুরুমশায় গুরুমশায় আর বলব কি
বেত বনের আসামী হাজির করেছি
রাম তুলসী রাম তুলসী রাম তুলসীর পাতা
গুরুমশায় কয়ে দিছেন কান মলার কথা। '
--- বিষয়টি ব্যাখ্যা করলে দেখা যায়, কোনো বালক পাঠশালায় ফাঁকি দিয়ে লুকিয়ে ছিল বেত বনের আড়ালে, কিন্তু বাকি বালকদের বা মাস্টারমশায়ের হুকুম-পালনে সদাব্রতী গোয়েন্দা-টিমের নজর এড়াতে পারেনি সে বালক। তার ফলে তাকে সবাই মিলে পাকড়াও করে মাস্টারমশায়ের কাছে আনার সময় আসামী-ধরার সাফল্যে গোয়েন্দা-টিমের ঐ আনন্দ-গান।
জলধর সেন মহাশয় তার 'সেকালের পাঠশালা' রচনায় অনুরূপ শাস্তির কথা বলেছেন। ধরা যাক নিতাই নামে কোন এক বালক পাঠশালায় অনুপস্থিত। আমবাগানে বা জামবাগানে লুকিয়ে থাকা নিতাই ধরা পড়ে গেছে গোয়েন্দা ছাত্রদের হাতে এরপর নিতাইকে চ্যাংদোলা করে ঐ ছাত্ররা নিয়ে যাচ্ছে গুরুমশায়ের কাছে। যাওয়ার সময় তারা ছড়া কাটছে-
'নিতাই যাবে শ্বশুর বাড়ি সঙ্গে যাবে কে পাঠশালাতে জোড়া বেত নাচতে লেগেছে
এক তুলসী, দুই তুলসী, তিন তুলসীর পাতা গুরুমশাই বলে দিছেন কান মলবার কথা।'
-গরহাজিরাতে গুরুমশায়ের প্রথম শাস্তি জোড়া বেত আসামী-বালকের পিঠে নিশ্চিহ্ন হবে, এরপর প্রয়োজনে দ্বিতীয় শাস্তি- গুরুমশায়ের হুকুম মতো- 'ওকে উঠোনের রৌদ্রের মধ্যে ওর হাতের আড়াই হাত জমি মেপে-- দুই পা সেই পরিমাণ ফাঁক করে দাঁড় করা-- আর ওর দুই হাত সমুখ দিকে উঁচু করিয়ে দিয়ে তার উপর দুইখানি দশ ইঞ্চি ইট বসিয়ে দে।'
-- এই শাস্তির কথা আমরা আরও অনেকের লেখায় পাই। শ্রী কালীকৃষ্ণ ঘোষ, তার 'সেকালের চিত্র'(১৯১৮) গ্ৰন্থের গোড়াতেই সেকালের পাঠশালার সূত্রে এক গুরুমশায়ের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন- 'ভাই, এই যে ছেলে আমার কাছে দিতে আনিয়াছ, ইহার কেবল হাড় ক'খানি তোমার, চামড়া ও মাংস আমার। এই সর্ত্তে যদি ছেলেকে এখানে দিতে হয় দাও, না হয় তোমার ছেলে তুমি নিয়া যাও।'
আরও অন্যান্য তথ্যের মধ্যে উল্লেখ্য, সেকালের পাঠশালার পাঠ শুরু হতো সকাল থেকেই শেষ হতে সন্ধ্যে নামার আগে, মাঝখানে দু'বার বিরতি। প্রথমটা জলখাবারের ছুটি, যাকে বলা হতো 'এড়াভাত' এর ছুটি, যা সম্ভবত পান্তাভাত খাওয়ার ছুটি। তারপর আবার পাঠ। আর দ্বিতীয় বিরতি ছিল, দুপুর বেলার ভাতের ছুটি। সে ছুটি সবাই একসঙ্গে পেতো না, গুরুমশায় জানতেন কার বাড়িতে কখন ভাত হয় সেই অনুযায়ী তিনি পোড়োদের ছাড়তেন। আর সকাল-সকাল পাঠশালায় আসাটা ছিল ভালো ছাত্রের পরিচয়জ্ঞাপক। এই বিষয়টা আমরা বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' বা তারও কিছু পরবর্তী কাল অবধি খেয়াল করি। বিদ্যাসাগরের গোপাল পাঠশালায় সবার আগে যায়, আর রাখাল সবার শেষে যায়, ভালো ও মন্দের দুই নিদর্শন পাঠশালায় এহেন উপস্থিতি সেই সময়ের খুব বিচার্য বিষয়। তাই সেকালীন পাঠশালায় যে সবার আগে পৌঁছাতো তার হাতে গুরু মহাশয় বেত দিয়ে একটি শন্যি/শূন্য দিতেন, এরপর যে পৌঁছাতো তার একটি বেত, তারপরের জনের হাতে দুটি, এইভাবে তিন, চার, পাঁচ করে বেতের সংখ্যা বাড়তো। সবচেয়ে শেষে আসা 'রাখাল' এর অবস্থাটা সহজেই অনুমেয়।
তবে সব ছাত্রই যে অবনত মস্তকে গুরুমশায়ের শাস্তি মেনে নিত তা হয়তো নয়। সেকালও বেশকিছু বেয়াড়া ডানপিটে ছেলে ছিল বইকি। রাসবিহারী সেনের স্মৃতিধর্মী রচনায় সেরকমই এক মদনমোহন নামক দুষ্টু বালকের পরিচয় আছে, যে পাঠ চলাকালীন অঙ্ক করার পরিবর্তে তাদের পাঠশালার মাস্টামশাইদের কার্য-কলাপ নিয়ে একখানি পদ্য লেখে। পদ্যটা ছিল-
'হেডমাস্টার মুদের কামড়
তার নীচেতে নবনে বানর,
নবনে বানর বেড়ায় গাছে
বেণী বাঘ তার নীচে আছে।
বেণী বাঘের দাঁত খিটিমিটি
ফোর্থ মাস্টার বামা টিকটিকি,
গুপে পন্ডিত নষ্টের গোড়া
বিদ্যা বুদ্ধি কচুপোড়া।'
-- মদনমোহনের এরকম 'উচ্চমানের' কবিত্বের পরিণতি হলো ভয়ঙ্কর, বেণী মাস্টার মারফত ঐ কবিতা-লেখা শ্লেট জমা পড়লো হেডমাস্টারের জিম্মায়। ডাক পড়লো 'বিচ্ছু' মদনমোহনের, তৎক্ষণাৎ তার শাস্তি হলো হাত-পা বেঁধে বিছুটি-গাছের মার, তারপর শাস্তি ঘোষণা হলো আগামী সাতদিন পাঠশালার বারান্দায় রোদে সে হবে 'লাড়ুগোপাল'। অর্থাৎ হাঁটু মুড়ে বসে একহাতে ইঁট নিয়ে বসে থাকতে হবে। শাস্তি যে খুবই গুরুতর সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তবে এহেন শাস্তি দানের পরেও মদনমোহনের কবিত্বে ভাটা পড়ে নাই। পরে আরও কোনো এক কারণে তাকে 'লাড়ুগোপাল' সাজা ছেড়ে, সাজা স্বরূপ 'কেষ্টঠাকুর' সাজতে হয়, অর্থাৎ বেঞ্চের উপর একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা। তা সেই শাস্তিকেও পদ্যাকারে বেঁধে ফেললো স্বভাব-কবি মদনমোহন, লিখে ফেলল-
'ফোর্থ কেলাসে থার্ড মাস্টার থার্ড জানুয়ারী করে দিলে বেঞ্চির উপর মোহন বংশিধারী ।
বেণী মাস্টার মানুষ-বাঘ সদাই থাকে চটে চক্ষুদুটি মুদিত সদা পাছে নেশা ছোটে।
আর জন্মে বোলতা ছিল বেণী মাস্টার **
এই জন্মে তার হুলের বিষে প্রাণটা ঝালাপালা।'
-- নির্মম শাস্তিদানের এই নির্মেদ কবিত্বের নিদর্শন এবার পৌঁছালো মদনমোহনের বাড়ি অবধি, বাড়িতে ছিলেন মদনমোহনের পিসীমা, তিনি কবিতা শুনে চমৎকৃত হলেন, মদনমোহনের এই লেখনী সমৃদ্ধ গুণপনায় তিনি যারপরনাই মুগ্ধ, উল্টে তিনি গ্ৰামের মাস্টার বেণীকেই চোখা চোখা বিশেষণে বিশেষিত করলেন। সেকালের পাষান-হৃদয় মাস্টারমশাইদের দু'চার কথা শোনাতে পারতেন এই পিসিমারই। আর তখন প্রায় ঘরেই অকাল-বৈধব্যের কারণে দু'একখানা পিসিমা বিরাজ করতেন। নতুবা এহেন মাস্টারমশাইদের 'নৈরাজ্যে' প্রাণ টেকানো দুষ্কর ছিল। তবে মদনমোহনের মতো হাড়বজ্জাত ছেলেও ছিল, যাদেরকে বাগে আনাটাও ছিল কঠিন কাজ। এতখানি শাস্তির পরেও তার বদমাইশি কমেনি, মাস্টারমশাইদের বানর, টিকটিকি, বাঘ, বোলতার পাশাপাশি এমন শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যা রাসবিহারী সেন মহাশয় ছাপার অক্ষরে আনতে পারেননি। যদিও 'ঝালাপালা'র অন্ত্যমিলে কি 'সম্বন্ধীয়' শব্দ হতে পারে সে বিষয়ে আমরা অনুমান করতে পারছি।
সেকালের পাঠশালায় পাঠ সম্পর্কিত তথ্য-মধ্যে উল্লেখ্য- লেখা ও পড়ার বিষয় বলতে প্রথমে বর্ণ পরিচয়, বানান শিক্ষা, যুক্তাক্ষর বানান, নীতিবাক্য শেখা, পত্রলেখা, অঙ্ক- গণনা, শুভঙ্করী-আর্যা। শিক্ষণ-বই বলতে বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' বা মদনমোহন তর্কালঙ্কারের 'শিশুশিক্ষা'র থেকেও বেশি জনপ্রিয় ছিল 'শিশুবোধক' নামক এক সংকলন গ্রন্থের। উক্ত সঙ্কলন-গ্ৰন্থটি যেন পাঠশালার 'সিলেবাস' ভিত্তি করেই বানানো। আর লেখার ক্ষেত্রে ছিল বিশেষ শ্রেণীবিভাগ। প্রথম পড়ুয়াদের লেখার বন্দোবস্ত ছিল মেঝেতে, তারপর অক্ষরের ছিরিছাঁদ ঠিক হলে তালপাতায়, হাতের লেখার আঁকিবুকি সুন্দর ও মসৃণ হলে সে ছাত্র উন্নীত হতো কলাপাতায়। এরপর হস্তাক্ষর মাস্টারমশায়ের মনমতো হলে তাকে দেওয়া হতো কাগজ ও খাগের কলম। এই যে মেঝে < তালপাতা < কলাপাতা < কাগজ ----- এই পুরো লেখনীর যাত্রা পূর্ণ হতে লেগে যেত অনেক বছর। তালপাতা থেকে কলাপাতায় উন্নীত হওয়াটা ছিল উৎসবের মতো। কোনো কোনো বাড়িতে অনুষ্ঠানও হতো। আর কাগজ-কলম প্রাপ্তি তো শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার স্মারক। রাজনারায়ণ বসু মহাশয় তার 'সেকাল আর একাল' গ্ৰন্থে সেকালের পাঠশালার সম্পর্কে বলছেন, 'পাঁচ বৎসর হইতে দশ বৎসর বয়স পর্যন্ত্য তালপাতে, তারপর পনেরো বৎসর বয়স পর্যন্ত্য কলাপাতে, তারপর কুড়ি বৎসর বয়স পর্যন্ত্য কাগজে লেখা হইত। সামান্য অঙ্ক কষিতে, সামান্য পত্র লিখিতে ও গুরুদক্ষিণা ও দাতা কর্ণ নামক পুস্তক পড়িতে সক্ষম করা গুরুমহাশয় দিগের শিক্ষার শেষ সীমা ছিল।' রাজনারায়ণ বসুর পড়াশোনার শুরু পাঠশালায় হলেও পরবর্তীতে তিনি স্কুলের ছাত্র। যদিও জলধর সেন মহাশয়ের বক্তব্য অনুযায়ী- সেকালের সরস্বতী পুজোর দিন হাতেখড়ির রীতি ছিল (আজও আছে) এরপর একটি শুভ দিন দেখে পাঠশালায় ভর্তি, ছেলেরা প্রথম লেখা শুরু করতো তালপাতায় তারপর তালপাতার হাত ঠিক হলে ছেলেকে কলাপাতায় প্রমোশন' দেওয়া হতো। তারপর যখন হাতের লেখা গুরুমশাইয়ের মনের মতন হতো তখন ছাত্র কাগজ হাতে করতে পেতো। আর এই কাগুজে ছাত্র হতে সাধারণত ছাত্রের চার-পাঁচ বছর লাগতো। তিনিও বলছেন আমাদের পাঠশালায় তখন একখানি বটতলার বই আদর পেয়েছিল, সেখানির নাম 'শিশুবোধক'। তার আরও বক্তব্য- 'এই বইখানা ছেলেদের হাতে দেওয়া হতো না। এখানি পাঠশালার সম্পত্তি। বইখানির আগাগোড়া গুরুমশাই ও সর্দার পোড়োদের কণ্ঠস্থ ছিল। তারা সকল ছাত্রকে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে, সুর করে একটু একটু আবৃত্তি করতেন, আর সকল ছাত্র তেমনি করে আবৃত্তি করত।'
স্কুল-শিক্ষায় শিক্ষিত পরবর্তীতে ইংরেজি শিক্ষায় পরিশীলিত রাজনারায়ণ বসুর মতো অনেকেই পাঠশালার শিক্ষাকে একটু অন্য নজরে দেখলেও, রায়বাহাদুর জলধর সেন পাঠশালার পক্ষে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন, তিনি বলছেন- 'এই বাঙালা স্কুলে পড়াশোনার ব্যবস্থা আর পাঠশালার পড়াবার রীতি, এর মধ্যে কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, এরকম যদি কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে আমি নিঃসংকোচে বলব যে আমাদের ছেলেবেলায় আমরা পাঠশালে যে শিক্ষা পেয়েছিলাম, তা স্কুলের শিক্ষা অপেক্ষা অনেক ভালো।'
সব দিক বিচার করে বলা যায় যে, পাঠশালার পাঠে হয়ত সীমাবদ্ধতা ছিল। কিন্তু একথা মানতেই হবে যে, আড়াই থেকে তিন শতক বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার বিস্তীর্ণ এলাকায় যে লক্ষাধিক পাঠশালা ছিল, সেখানে প্রয়োজনীয় বাংলা এবং নিত্য ব্যবহার্য অংকের যে পদ্ধতি ও প্রকরণ চালু ছিল তা সেই সময়ের জনজীবনের পক্ষে ভীষণই সহায়ক হয়েছিল। পাঠশালা উঠে যাওয়ার পরেও আরো কয়েক দশক স্কুলের গায়ে পাঠশালার আলো-ছায়া থেকে গিয়েছিল। স্কুল ছুটির বেলায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে কোরাসে নামতা পড়ার অভিজ্ঞতা তো আমরাই লাভ করেছি গত শতকের ন'য়ের দশকে, সে অভিজ্ঞতায় এটা মানতে বাধ্য এক থেকে কুড়ির কঠিন নামতা রপ্ত হয়েছিল, ঐ সমবেত সরব পাঠের অনায়স ছন্দে।
আর পাঠশালার মুক্তাঙ্গনে এরকম অনায়স ছন্দে, অনাবিল আনন্দে অনেক অনেক কিছুই রপ্ত হতো যা অর্থ উপার্জনের সহায়ক না হোক, জীবনযাপনে শিক্ষার্জনের অর্থ জানতে সহায়ক হতো।
সহায়ক গ্ৰন্থ :-
১. বাংলার দেশজ শিক্ষাধারা, পরমেশ আচার্য, অনুষ্টুপ প্রকাশনী, ২০০৯।
২. সেকালের শিক্ষা/উজ্জ্বল উদ্ধার, সঙ্কলন-সম্পাদনা- অপূর্ব সাহা, আলাপ প্রকাশন।
৩. সেকালের কথা, রায় শ্রীজলধর সেন বাহাদুর, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স, ১৩৩৭।
৪. সেকাল আর একাল, শ্রীরাজনারায়ণ বসু, বাল্মীকি যন্ত্র, ১৭৯৬ শকাব্দ।
ব্যাক্তি ঋণ :-
দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে.মু), সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়
Comments