পশ্চিমবঙ্গে সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার - সুমন নাথ
- Sneha Roy
- Jul 8, 2021
- 5 min read
Updated: Jul 10, 2021

প্রাবন্ধিক : সুমন নাথ
অনেকের কাছেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি ব্যাপারটা কাঁঠালের আমসত্ত্বের মতো। রাজনীতি রাজনীতি, সংস্কৃতি সংস্কৃতি, এমনটাই বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত আমরা। বাড়ির ছেলে মেয়েকে আমরা রাজনীতি করতে বারণ করি কিন্তু ক্লাবে ২৫শে বৈশাখে পাঠিয়ে দিই – “বাবা বাছা, গানটা, কবিতাটা করে আয়”। গানে কবিতাতে রাজনীতি নেই এই বিশ্বাসে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গড়পড়তা সংস্কৃতি বলতে বুঝে এসেছেন ২৫শে বৈশাখে রবীন্দ্রজয়ন্তী, বছরে একটা বইমেলা, আর এলিট লোকের ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গিয়ে সিনেমা চর্চার ভান করা। দেশের সংস্কৃতির পীঠস্থান ধরে নিয়ে (কেউ বলেনি কিন্তু, এমন কোনও খেতাব এই শহর কোনোদিন পেয়েছে বলে শুনিনি) বাঙালি কাগজের বই, পর্দার বই- মানে সিনেমা আর রবি ঠাকুর নিয়ে দিব্য দিন কাটিয়েছে ২০১১ পর্যন্ত।

ছবি : গুগল
নন্দন, রবীন্দ্রসদন এই সংস্কৃতির রাজধানীর রাজভবন কিংবা রাইটার্স ধরে নেওয়া ছিল এক সহজাত প্রবৃত্তি। আর তার সঙ্গে অন্য সকল প্রকার সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে কিঞ্চিত খাটো করে রাখা ছিল একটি বহমানতা। ২০১১ সালের পরেই যে নতুন সরকার এলেন, তাঁরা এই বাঙালি-র সংজ্ঞার মধ্যে বহুদিনের সযত্নে লালিত–পালিত উচ্চমার্গের সংস্কৃতি (high culture), যা কিনা রেসিজম এর সামান্য বিটনুন, এবং অবজ্ঞার অসামান্য চাট মশলা সহযোগে সংস্কৃতি নামক তন্দুরির সঙ্গে পরিবেশিত হচ্ছিল তাকে ধাক্কা দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একদল সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বনামধন্য সমাজ বিশ্লেষক তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে subaltern খুঁজে পেলেন।

ছবি : গুগল
এই subaltern জমি দালালী করে, কাট মানি খায়, মিথ্যেকথা বলে, সি পি আই এম কতৃক সুপ্রতিষ্ঠিত মারপিটের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। এই subaltern প্রাসাদ বানায়, যে কোনো রকমের আন্দোলনকে দমিয়ে দিতে চায় কিন্তু তবুও এরা subaltern। এই সমাজ গবেষকের দল প্রান্তিক লেখকের মিথ্যে ও ভুলে ভরা লেখাকে সযত্নে তুলে ধরেন বিশ্বের আঙিনায়। সে সব নাকি subaltern সংস্কৃতির মণিমুক্ত। তো, এই লেখাটা আমাকে পেয়েছে এই পুরো ঢপবাজিটাকে একটু নেড়ে চেড়ে দেখার জন্য। মোটের ওপর এটুকু বোঝা যায় যে সংস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলে জানতে অভ্যস্ত আমরা, তা আমরা মানি বা না মানি সততই ক্ষমতার আশেপাশে বিচরণ করতে পছন্দ করে। মানে এই ধরুন, কদিন আগে যে সকল লোকজন dover lane এ বসে গান শুনতে শুনতে না ঢুললেই তাঁকে সংস্কৃতিবান বলে ভাবা প্র্যাকটিস করেছিল তারাই এখন subaltern শুনে বুঝে বেশ তৃপ্ত। অতি সম্প্রতি এই ২০২১ সালের গেল গেল রব তোলা ভোটের আগে আবার subaltern হিন্দুত্ব নিয়ে বেশ লাফালাফি দেখা গেছিল এসব কী? একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক।

ছবি : গুগল
এই ধরুন বইমেলা, film festival, উৎসবের মত করে মে দিবস নভেম্বর বিপ্লব উদযাপন ইত্যাদি যে সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক মান্যতা দেয় তা একটি আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার প্রয়াসের অংশ। এই ধরনের প্রয়াস যেমন এক বামপন্থী সংস্কৃতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করতে চায়, তেমনি এর বাইরে পড়ে থাকা অগণিত লোকসংস্কৃতিকে অচিরেই low culture এ রুপান্তরিত করে ফেলে। এই ট্র্যাডিশন দীর্ঘমেয়াদী স্তরে, একটি বিশেষ রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক নির্ভর সংস্কৃতির জন্ম দিতে পারে, যা পশ্চিমবঙ্গবাসী দেখেছে। বামপন্থী রাজনীতি খুব সহজেই দুর্গাপূজার মত পপুলার সংস্কৃতিকেও ব্রাত্য রেখেই শাসন চালাতে পেরেছে।

ছবি : গুগল
এর মূল কারণ হলো একটি পৃথক সাংস্কৃতিক ভাষা এবং ভাষ্য তৈরি করা এবং একটি শক্তপোক্ত সংগঠন বামেদের ছিল। এই সংগঠনকে ভিত্তি করে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজ্য জুড়ে আবর্তিত হতো তা অচিরেই সমস্ত low culture এবং চিরায়ত সামাজিক মাধ্যমগুলিকে অবদমন করে ফেলেছিল। ফলত, সর্বত্র রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহনে পার্টির সংগঠন সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে নিত। মানে কে আবাস যোজনার বাড়ি পাবে, কাকে বিয়ে করে সেই বাড়িতে থাকবে এবং কাকে কাকে নেমন্তন্ন করবে সেটা প্রায়শই পার্টি ঠিক করে দিত। যদি সমসায়িক রাজনীতিকে সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখি, তাহলে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে, ঠিক এই ফাঁক দিয়েই বিরোধী রাজনৈতিক সংস্কৃতির উদ্ভব, পরিণতি এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন। রাজনৈতিক পালাবদলের বহু আগেই কলকাতার সমস্ত পূজা উদ্যোগ তৃণমূলের heavyweight নেতাদের হাতে চলে এসেছিল। সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির সতত পরিবর্তন এই সময় থেকেই। অর্থাৎ dover lane যাইনা, শুধুই টুনির মা ভালো লাগে তার মানে এই নয় যে আমাদের সংস্কৃতির কোন মূল্যই নেই। কতকটা এমনই একটি কথা শুনে চমকে গেছিলাম ২০১০ সালে বাঁকুড়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামের আমারই এক সমবয়স্ক আদিবাসী ছেলের সরকার পরিবর্তন হলে দাবি ছিল তাঁদের সংস্কৃতির প্রতি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। অভিমান ঝরে পড়ে সে ছেলের গলায় “শুধু তোমাদের নাচগান, তোমাদের রবীন্দ্রসঙ্গীত? আর তোমরা আমাদের চিনেছ শিলাজিত দিয়ে!” “তা বটে,” আর একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে আমি হোঁচট খাই। অনেক দূরে নদী বাঁধের পাশ থেকে একটা মাদল বুঝি বাজছিল সেদিন। ঠিক তার দু বছর পরে মানে ২০১২ সালে দেখলাম মকর সংক্রান্তির মেলার আমূল পরিবর্তন। সংক্রান্তি, শিকার উৎসব সর্বত্রই পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিজেদের স্টল সাজিয়েছেন। দারুণভাবে সরকারি বিভিন্ন স্কিমের প্রচার, সচেতনতা বৃদ্ধির শিবির এবং মেলার জন্য অর্থ সাহায্য সবই চলছে। বাঁকুড়া পুরুলিয়ার মত জায়গায় সাঁওতালি নাচের প্রতিযোগিতা শুরু হল বৃহৎ আকারে আর বিজয়ীদের সুযোগ মিললো শহরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেদের সংস্কৃতি কে তুলে ধরার। গুশকরায় যে ডোকরা গ্রাম অন্ধকার এক বস্তির মত পড়ে ছিল, সেখানে তৈরি হল কমিউনিটি সেন্টার। ঝাঁ চকচকে প্রবেশ তোড়ন। একই ভাবে পটচিত্র গ্রামের মধ্যেই শুরু হল প্রশিক্ষণ কর্মশালা, museum। যাত্রা উৎসব, মাটি উৎসব, দুর্গাপূজা carnival ঠিক যতটা শহুরে লোকের মনে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মাণ শুরু করেছে, তেমনই আগের একটি বেশ elite ক্লাস সংস্কৃতিকে প্রশ্ন করেছে, ভেঙ্গে দিয়েছে।

ছবি : গুগল
এই নতুন ধরনের যে সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল নির্মিত হল পশ্চিমবঙ্গে তা অনেকের কাছে subaltern, অনেকের কাছে lumpen বাজি, অনেকের কাছে গেল গেল সব গেল কাছা খুলে যাওয়া অবস্থা। কিন্তু কেউই এই নব্য কলেবরে সজ্জিত সংস্কৃতির ক্ষমতাকে অস্বীকার করবার ক্ষমতা রাখেন না। প্রশ্ন উঠতে পারে, এইভাবে সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার করা কেন? কী এমন দরকার পড়ল? এর উত্তর খুঁজতে হলে সবার আগে এটা মানতে হবে যে ২০১১ সালের আগেও সংস্কৃতির রাজনৈতিক ব্যবহার ছিল, বেশ জোরালো ভাবেই ছিল। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকে সংস্কৃতি রাজনীতির একটি মূল প্রকরণ হয়ে উঠল কিভাবে? এর একটি প্রধান কারণ তৃণমূলের সংগঠন তৈরির প্রতি অনীহা। বামেদের যে সাংগাঠনিক ভিত্তি তৈরি হয়েছিল সে সব ভেঙ্গে ফেলে এক নতুন ধরনের সামাজিক মাধ্যম তৈরি করার চেষ্টা তৃণমূলের ছিল না, বরঞ্চ, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং স্থানীয় সংগঠনগুলির রাজনৈতিক ব্যবহারই একমাত্র বিকল্প হিসেবে উঠে আসতে থাকে। তৃণমূল স্তরের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলি। যে সকল প্রকল্পে একসঙ্গে অনেকের উপকার করা যায় না, সেগুলি কাকে দেওয়া হবে এবং কে বাদ যাবে তার সুচারু বণ্টন এক কঠিন পরীক্ষা, বিশেষত গ্রাম পঞ্চায়েতে। যে পার্টি সেখানে সহমত নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নিত, সেই জায়গায় একজন বা কয়েকজন মাতব্বর দিয়ে খুব বেশিদিন চলা যায় না। জনমানসে অসন্তোষ তৈরি হওয়া খুব স্বাভাবিক। অথচ সংগঠন গড়ে উঠছে না। অতএব সংস্কৃতি কে ব্যবহার করা হয়ে গেল একটি সুস্পষ্ট বিকল্প। তথ্য ও প্রযুক্তি দফতরের অর্থ বরাদ্দ বেড়ে ২০১৬-২০১৭ সালেই ২০১১ সালের তুলনায় ৫ গুণ হয়ে যায়।

ছবি : গুগল
ছন্দ পতনের শুরু ইমাম ভাতা দেওয়া থেকে। দুর্গাপূজা এবং মহরম একসাথে হওয়ায় বিসর্জন বন্ধ করা থেকে সূচনা হলো একটি নতুন ধরনের সাম্প্রদায়িক-রাজনৈতিক প্রতিরোধ। সাম্প্রদায়িকতার যে গোপন কিন্তু দুর্নিবার বীজ রয়ে গেছে এ রাজ্যের মানুষের মনের গভীরে তা নিয়ে শুরু হলো এক কদর্য খেলা। যে জাদু বলে সমাজে উচ্চাসনে বসে থাকা শিক্ষিত মানুষ অবলীলায় বলে ফেলেন যে মোল্লাগুলো হেলমেট পরে না কিংবা মাস্ক পরে না, তা শিহরিত করে। একইভাবে শিক্ষিত মুসলমান মানুষ চলে যান মজলিসে, মাথা নাড়েন যখন হুজুর বলে ওঠে মূর্তি পুজা যারা করে তাঁরা শত্রু! রাজ্য জুড়ে শুরু হয় ধর্মীয় হানাহানি। দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হয় শিল্পাঞ্চলে, সীমান্ত অঞ্চলে। ঠিক যে জায়গায় তৃণমূল নজর দেয়নি, অর্থাৎ সংগঠন তৈরি করা, সেখানেই সংগঠিত হয় বিজেপি। প্রায় অপ্রতিরোধ্য তাদের গতি। লোকসভা ২০১৯ এই একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি বিরোধী দল হিসেবে উঠে আসছে এবং এই উত্থান অবশ্যই ধর্মীয় রাজনীতির বিমানে চেপে। এই উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে একাধিক invented traditions উঠে আসল যেমন রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী, বিশালাকার জন্মাষ্টমী ইত্যাদি। এর মধ্যে রামনবমী এবং হনুমান জয়ন্তী কে কেন্দ্র করে সংগঠিত হল দাঙ্গা এবং প্রানহানি। আর.এস.এস এবং বিজেপির পাতা ফাঁদে তৃণমূল পা দিল এবং competitive communalism এর সূচনা ঘটলো। রাজ্যে এক অভূতপূর্ব হিংসা, হানাহানি, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং ঘৃণার সংস্কৃতি দানবাকারে বাড়তে লাগলো। ২০২১ এর নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গবাসী যে ভাবে বিজেপিকে আটকালো তাতে আহ্লাদিত হবার কিছু নেই। মূলত বিজেপি বিরোধী ভোটের কেন্দ্রীকরণ হয়েছে তৃণমূলের ভাঁড়ারে। তৃণমূলের service delivery কেন্দ্রিক রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন শেষ রক্ষা করতে পেরেছে। কিন্তু বিধানসভায় এই মুহূর্তে যে দুটি দল থাকছে, তাঁরা দুজনেই সাংস্কৃতিক প্রকরণকে যে কোনো উপায়ে রাজনৈতিক ব্যবহারে পিছপা হন না। Indian Secular Front এর একমাত্র প্রতিনিধি রয়ে গেলেন বাম ও কংগ্রেসের তরফ থেকেও। সে অর্থে দেখলে, এই মুহূর্তে একটি হিন্দুত্ববাদী দল ৩ থেকে আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ৭৭ এ নিয়ে গেলেন, একটি বহুলাংশেই শরিয়তি ইসলামিক মতাদর্শ দ্বারা পরিচালিত দল ০ থেকে ১ হলেন আর বাম-কংগ্রেস বিধানসভা থেকে বাইরে থেকে গেলেন। সংস্কৃতির সুচারু ব্যবহার থেকে ধীরে ধীরে বাংলার মানুষ যে অনেক উদগ্র ব্যবহার আগামী দিনে দেখবেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবাসী এবারে dover lane এর সঙ্গে সঙ্গে চাপাতি, ত্রিশুল দেখার জন্য তৈরি হন, কিংবা স্কুল থেকে শুরু করুন সহাবস্থানের প্রচার। সংস্কৃতি থাকবে, রাজনৈতিক ব্যবহার যেমন–যেমন দরকার তেমন–তেমন হবে, সাধের বাংলা থাকবে তো?
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Comments