বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: এক মহৎ-সঙ্গ কথা' তাঁর পুরুলিয়া পর্বের স্মৃতিচারণায় -অনুপ মুখোপাধ্যায়।
- Avijit Mitra
- Jul 7, 2021
- 9 min read
Updated: Jul 10, 2021

লেখক : অনুপ মুখোপাধ্যায়
‘আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই, শুধু তার স্বাদ তোমারে কি শান্তি দেবে? আমিও চলে যাবো- তবু জীবন অগাধ তোমারে রাখিবে ধরে সেইদিন পৃথিবীর পরে, আমার সকল গান তোমারে লক্ষ্য ক’রে l’ বুদ্ধদার চলে যাওয়ার পর কেবলই কবিতার এই শব্দ গুলো অনুরণিত হচ্ছেl বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কে নিয়ে কিছু লেখা বড় দুষ্কর। এই রকম মাপের খুব কাছের মানুষ কে ঘিরে স্মৃতির কোলাজ তাঁর অনুপস্থিতিতে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলেছে। এই ধরনের ব্যক্তিগত প্রকাশ ভঙ্গিমা, পাঠকদের কারো কারো কাছে একঘেয়ে, ক্লান্তিকর ঠেকতে পারেl এই সময় আত্মকথন চিৎকৃত স্বরে অন্যকে শোনানোটাই যেন রেওয়াজ হয়ে l সেটাও খুব অস্বস্তিকর। বুদ্ধদার সঙ্গে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের সম্পর্কl সত্তরের দশকের শেষদিকে এ রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবাদলের সঙ্গে সঙ্গে শিল্প সংস্কৃতি জগতেও বদল ঘটেছিলl নব্যধারার সিনেমা নির্মাণে সেদিন যাঁরা সামনের সারিতে ছিলেন, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত তাঁদের অন্যতম। সেসময় জেলা মফস্বলে ও সিনেসোসাইটি আন্দোলন তুঙ্গে l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির সঙ্গে পরিচয় সেই আন্দোলনের সুবাদেইl হঠাৎই একদিন হাজির হয়েছিলাম তাঁর সেলিমপুরের বাড়িতে l কোন পূর্ব নির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট ছাড়াইl তাঁর কথাবার্তা শুনে সেদিন যে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তা বলার কোন অবকাশ নেই। জীবনের যাত্রাপথে তাঁর স্পর্শ লাভে যে ধন্য হয়েছি তা বলাই বাহুল্য l তখন তো আমার বাড়িতে ফোন নেই, অগত্যা ভরসা পত্রালাপl সেসময় মফস্বল থেকেই মহানগরী তে যাওয়ার সুযোগ হত কালে-ভদ্রেl ১৯৯৮ সালের কোন একদিন তাঁর চিঠি এলো ডাকযোগে। জরুরি প্রয়োজনে তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ। দরকারটা ছিল সিনেমারl তিনি তাঁর নতুন ছবি ‘বাঘ বাহাদুর’ নির্মাণের প্রস্তুতি নিচ্ছেনl বুদ্ধদার ইচ্ছে পুরুলিয়ার ভার্জিন লোকেশনে এই ছবির শ্যুট করারl আমায় ছবির চিত্রনাট্য পড়তে দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন পুরুলিয়ায় উপযুক্ত লোকেশন পাওয়া যাবে কি না? সম্মতি জানাতেই বুদ্ধদা নির্ধারিত দিনে পুরুলিয়ায় পৌঁছেছিলেন। সেই পাঁচ বছর বয়সে পুরুলিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার পর প্রথম পুরুলিয়ায় এলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন তাঁর একসময়ের সহযোগী পরিচালক তথা তাঁর অনেকগুলি ছবির সংগীত নির্দেশক বিশ্বদেব দাশগুপ্ত। সম্পর্কে তাঁর সহোদর। মনে পড়ে সন্ধ্যেবেলায় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা সেদিন অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছেছিলাম l ছিলাম CADC-এর অতিথিশালায়। তখন তো তেমন থাকার জায়গা নেই পাহাড়। শহরের অবস্থাও তথৈব। আজকের মতো হোটেলের তেমন রমরমা ছিলনা সেদিন। ছবির লোকেশন পছন্দ হলেও অন্যান্য লজিস্টিকের কারণে এ ছবির শুটিং শেষ পর্যন্ত পুরুলিয়ার পরিবর্তে উড়িষ্যায় স্থানান্তরিত হয়l তবে লোকেশন বাতিল হলেও, আমি জড়িয়ে থাকলাম বুদ্ধদার কাজের সঙ্গে। উড়িষ্যায় গিয়ে বোঝা গেল, কী কারনে তিনি লোকেশন হিসেবে পুরুলিয়ার কথা ভেবে ছিলেন। প্রাকৃতিগত সাদৃশ্যই এর বড় কার। এ ছবির নির্মাণ পর্ব এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা। সে অর্থে প্রথম কোন ছবিতে সক্রিয় অংশ নেওয়া। তাও বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের মতো পরিচালক। শতাধিক লোকজন নিয়ে ইউনিট l সবকিছু হচ্ছে একবারে ঘড়ি ধরে l কখনো ভোর তো কখনো রাতবিরেতেও ছবির শ্যুট চলছে সমান তালে l এ এক বিপুল কর্মযজ্ঞ। জ্যান্ত বাঘ নিয়ে শুটিং। প্রযুক্তিগত কোনো কৌশল না নিয়ে একেবারে হাড়হিম করা দৃশ্য। পবন মালহোত্রা, অর্চনা, বাসুদেব রাও, রাজেশ্বরী রায়চৌধুরী, বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় সবাই যেন এখানে শিক্ষার্থীl বুদ্ধদার ভঙ্গিমা শিক্ষক সুলভ নয় l কিন্তু প্রতিটি দৃশ্যগ্রহণ যেন সেলুলয়েডের পাঠদান পর্ব। সিনেমার এ এক নতুন পাঠোদ্ধার l প্রযুক্তি, লেন্সের ব্যবহার তার সঙ্গে লোকেশন, অভিনেতার কম্পোজিশন, অভিনয় রীতি সব মিলিয়ে এ এক নতুন রসায়ন। সাহিত্যের ভাষার চেয়ে সিনেমার ভাষা যে স্বতন্ত্র, সেটা প্রথম উপলব্ধি করলামl

ছবি : গুগল
গোটা ইউনিটের পরিবেশটাই আলাদা l পরিচালক, চিত্রগ্রাহক, অভিনেতা কেউ কারো থেকে বিচ্ছিন্ন ননl কোনো ব্যবধান নেই কারোর l সবাই একটি ভালো ছবি তৈরির স্বপ্নে যেন বুঁদ হয়ে আছেন l ঐ সেটে বসেই কাজের ফাঁকে কতধরনের আড্ডা হত l গান, কবিতা, রাজনীতি সবকিছুর হাত ধরে সিনেমার পাঠ গ্রহন ছিল বড় প্রাপ্তি l শুটিং থেকে হোটেলে ফিরে পরের দিনের প্রস্তুতি l কোন ভুল হয়ে থাকলে তাকে শুধরে নেওয়ার পরিকল্পনা করতেন পরিচালক l কঠোর শৃঙ্খলায় বাঁধা থাকতো ইউনিটের প্রতিটি কাজকর্ম l এখানে এসেই দেখলাম বুদ্ধদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরেক বিশিষ্ট চিত্র পরিচালক বিপ্লব রায়চৌধুরী, শুটিং-এর তদারকি করছেন বন্ধুত্বকে ভালোবেসে l সিনেমাকে ভালোবেসে lএমন উদাহরণ কি খুব মেলে? এসবই শিল্প আর জীবন চর্চায় প্রয়োজনীয় আহরণ l সিনেমার যাত্রাপথে নিয়মিত পথিক না হয়েও, এরপর বুদ্ধদার সঙ্গে যোগাযোগটা থেকেই গেল l লেখালেখি, সাক্ষাৎকার গ্রহন, কবিতা সংগ্রহের মতো নানা কাজের সূত্র ধরে তাঁর সান্নিধ্যের অভাব হয়নি আমার জীবনে l ততদিনে আমার বাড়িতে ফোন এসেছে l বুদ্ধদা ফোন করে বললেন, “ সমরেশ বসুর ‘উরাতিয়া’ গল্পটি পড়েছো? পড়ে ফ্যালো l এটা নিয়েই পরের ছবি l তুমি বলো, এরকম লোকেশন পাবো কিনা? ” এরপর কলকাতায় ডাক পড়লো l তাঁর বাড়িতে যেতেই চিত্রনাট্যের খসড়া পড়তে দিলেন l ততদিনে আমারও বয়সের বেলা বেড়েছে খানিকটা l তখন আমি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে সারা জেলা চষে বেড়াই l আমার বাসভূমিকে চেনা জানার চোখ আর পরিধি বেড়েছে l বুদ্ধদা বলতেন, “ তোমার চোখ ই হচ্ছে আসল l তুমি চোখ দিয়ে যা দেখছো সেটাই তো ফ্রেম l আমার কাছে ইমেজতো সেভাবেই ধরা পড়ে । ” আমিও ছবির প্রয়োজনীয় লোকেশন দেখা শুরু করলামl সম্ভবত ৯৯-এর ডিসেম্বরের শেষে বুদ্ধুদেব দাশগুপ্তের ছবি নিয়ে রেট্রোস্পেক্টিভ অনুষ্ঠিত হয়েছিল l উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া l বুদ্ধদা আর তাঁর প্রধান সহকারী অরুণ গুহঠাকুরতা এসেছিলেন ঐ উৎসবে অংশ নিতে l তাঁদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল কাশীপুর বনবাংলোয় l আমার ডাক পড়লো সেখানে l ওখান থেকেই একেবারে হাড় কাঁপানো শীতে ভোর বেলায় আমরা বেরিয়ে পড়লান লোকেশনের সন্ধানে l দুদিনে জেলার বহু জায়গা চষে ফেললাম বটে, তবে ছবির বহু প্রয়োজনীয় জায়গা যে এখনো মেলেনি!বুদ্ধদা বললেন, “ গন্ধ পাচ্ছি, হবে l ” সে যাত্রায় একটা তালিকা দিয়ে গেলেন l সেই মতো এবার আমার প্রস্তুতি নেওয়ার পালা l মাসখানেক পর আবার এলেন l এবার সঙ্গী পরিচালকের সেই সহকারী বিশ্বদেব দাশগুপ্ত l জঙ্গল, রেল গেট, চার্চ, গ্রাম, মেঠো রাস্তা, হাইওয়ে সব পছন্দ, কিন্তু তখনো দুষ্প্রাপ্য ছবির মূল লোকেশন l একটা টিলা l যেখান হবে কুস্তির আখড়া l পাশ দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন l দুএকটা দেখা হয়েছে বটে, যেন পেয়েও পাচ্ছিনা l বুদ্ধদা আমাকে চিঠিতে যেভাবে ছবি এঁকে বার্গম্যান এর ছবির রেফারেন্স দিয়েছিলেন, সেই দিগন্ত জুড়ে প্রান্তর, টিলা... l সেসব যেন পেয়েও পাচ্ছিনা l দুদিন খুঁজে বেড়ানোর পর বুদ্ধদার কলকাতায় ফেরার কথা, খানিকটা বিফল মনোরথ হয়েই l আমারও মন খারাপ l এবারো হলনা বোধহয় l ফস্কে গেল l শেষ বিকেলে হাইওয়ে দিয়ে পুরুলিয়ায় ফিরছি l শহরে ঢোকার কুড়ি কিলোমিটার আগে মূল রাস্তা থেকে দূরে একটা উঁচু-নিচু ঢালের রেখাচিত্রে চোখ গেল আটকে গেল l বুদ্ধদা গাড়ি থামাতে বললেন l বললেন, “ চলো ওখানটায় নিয়ে চলো l ” গ্রামের অপরিচিত এবড়ো-খেবড়ো রাস্তা দিয়ে মিনিট পনেরো পর গন্তব্যে পৌঁছালাম l বুদ্ধদার সারা মুখে তখন তৃপ্তির হাসি l বললেন,“ পেয়ে গেছি l সব পেয়ে গেছি l এখানেই সব হবে l কতবার এই লোকেশনের ধার কাছ দিয়ে গেছি l কিন্তু নজরে পড়েনি l ” বুদ্ধদার অনুসন্ধিৎসু চোখে এবার ধরা পড়লো l বুদ্ধদারা সেদিন আর কলকাতায় ফিরে গেলেন না l লোকেশন খুঁজে পাওয়ার আনন্দে সেদিন আমরা হুইস্কি খেয়ে, আড্ডা দিয়ে সেলিব্রেট করলাম l ‘উত্তরা’র শুটিং এর আগে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন পরিচালক l আর প্রতিবারই যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে তাঁর এই নির্মাণ সফর l প্রতিবারই ছবির চিত্রনাট্যে বদল ঘটেছে l কখনো নতুন দৃশ্যের জন্ম হয়েছে, কখনোবা নতুন চরিত্রের প্রবেশ ঘটেছে l এই ছবিতে পাদ্রির চরিত্রটি তো এভাবেই এসেছিল l লোকেশন খোঁজার সময় সংবাদ পত্রে প্রকাশিত হয়েছিল উড়িষ্যায় একটি চার্চে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনা l আবার বাগাল মেয়েটি এবং তার শাশুড়ির দুঃখ বৃত্তান্ত তো, লোকেশন খুঁজতে গিয়ে এক বৃদ্ধার মুখ থেকে শোনা তার জীবন কথা l বাস্তবের নানান ঘটনাবলি, চরিত্ররা এভাবেই জায়গা করে নিয়েছে তাঁর বিভিন্ন ছবিতে l তাঁর একটি ছবিতে আদর্শকে আঁকড়ে থাকা এক শিক্ষকের চরিত্র আমার এক বন্ধুর আদলে গড়ে ওঠা l শুধু প্রাক-নির্মাণ পর্বেই না, শুটিং চলাকালীন সময়েও বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম হয়েছে এভাবেই বাস্তব আর পরা-বাস্তবের সংমিশ্রনে l সে বাসের মধ্যে মানুষের সঙ্গে গরু, ছাগল, মুরগির সহাবস্থানই হোক, কিংবা গাঁয়ের হাটে নতুন বর-বৌ-এর ষ্টুডিওতে ছবি তোলা, অথবা সাইকেলের রডে বসে ছাগলের সওয়ার হওয়া,— সবই এসেছে এই জনপদের লৌকিক জীবন থেকে l ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ ছবির গাধাটিও এসেছিল এভাবেই l একটি মেলায় গাধার কৌতুক মিশ্রিত আজব কান্ড দেখেই, ছবির চিত্রনাট্যে তাকে জায়গা দেওয়া হয় l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবির অসংখ্য চরিত্রকে যাঁরা প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন, তাঁরা অনেকেই পুরুলিয়ার স্থানীয় শিল্পী l সে অর্থে তাঁরা ফিল্মের কোনো পরিচিত মুখ নন l এই দলে স্থানীয় নাট্য দল কিংবা লোকসংস্কৃতির সাথে যুক্ত শিল্পীরা যেমন ছিলেন, তেমনি যাঁরা অভিনয়ের অ আ ক খ জানতেন না, তাঁদের দিয়েও অবলীলায় অভিনয় করিয়ে চরিত্র গুলোকে বিশ্বস্ত করে তুলেছেন তিঁনি l তাঁর কাছে চরিত্র নির্বাচনে চেহারাটা ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ l তাই বহু নন-এক্টরকে দিয়েও উচ্চ মানের অভিনয় করিয়ে নিয়েছেন l এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে ‘উত্তরা’ ছবিতে পোস্ট-অফিসের এক দৃশ্যে এক বৃদ্ধ, যিনি অন্যের চিঠি লিখে দেন l এই মানুষটি বাস্তবে ছিলেন দলিল লেখকের পেশায় নিযুক্ত l তাঁকে দিয়েই অসাধারন অভিনয় করিয়ে নিয়েছিলেন পরিচালক l এই ছবিতেই এক বৃদ্ধা পিসির একটি চরিত্র ছিল l এই চরিত্রের জন্য তথাকথিত কোন পেশাদার অভিনেত্রীকে তাঁর পছন্দ হচ্ছিল না l অনেককেই বাতিল করলে। শেষ পর্যন্ত, বিখ্যাত ঝুমুর শিল্পী, যিনি নাচনি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, সেই সিন্ধুবালা দেবীকে দিয়ে এই চরিত্রে অভিনয় করালেন বুদ্ধদা l এই প্রসঙ্গে একটি মজার ঘটনা না বললেই নয় l শ্যুটিংয়ের কয়েকদিন আগে বুদ্ধদা সিন্ধুবালা দেবীকে দেখে সম্মতি দিয়েছেন l নির্দিষ্ট দিনে তিনি উপস্থিতও হয়েছেন শুটিং এর জন্য l শর্ট এর আগে ওনাকে দেখে তো পরিচালকের চোখ কপালে ওঠার যোগাড় l বুদ্ধদা বলছেন, “ কে ইনি? চেহারা তো বদলে গেছে l চেনা যাচ্ছেনা l ” একমাথা পাকা চুলের জায়গায় কালো কুচকুচে চুল নিয়ে হাজির অভিনেত্রী l আসলে সিনেমায় এই নাচনি শিল্পী তার পাকা চুল দেখাতে রাজি নন l অবশেষে অনেক বুঝিয়ে মেকআপ ম্যান দেবী হালদারের চেষ্টায় মুশকিল আসান হয়েছিল l অভিনয় প্রসঙ্গে বুদ্ধদা বারবার বলতেন সিনেমার অভিনয় আর থিয়েটারের অভিনয়ের যে সূক্ষ্ম পার্থক্য বিদ্যমান, তা অভিনেতাকে বুঝতে হবে l থিয়েটারের বহু বিশিষ্টরা তাঁর ছবিতে অভিনয় করে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন l বুদ্ধদার নির্দেশ সিনেমার অভিনয়ে নাটক করা যাবেনা l তাঁর ছবিতে বিজন ভট্টাচাৰ্য, সুব্রত নন্দী থেকে অশোক মুখোপাধ্যায়, সুনীল মুখার্জী, মাসুদ আখতার, মণিদীপা রায় ,অনসূয়া মজুমদারদের অভিনয় বড় প্রাপ্তি l আবার তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবির নায়ক নায়িকারাও তাঁর ছবিতে অভিনয় করে সোনা ফলিয়েছেন l তিনি বলতেন বাণিজ্যিক ছবির অভিনেতারাও খুবই শক্তিমান এদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারলে পরিচালকের পরিশ্রম লাঘব হয় l তাঁর ছবিতে মিঠুন থেকে তাপস পাল, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণার অভিনয়ে সে কথারই প্রমান মেলে l এঁদের অনেকেই জাতীয় পুরস্কার বিজেতা l উনি যখন কোন অভিনেতাকে অভিনয় করে দেখাতেন, তখন অভিনেতার দুর্বলতা ধরিয়ে দিতেন l যাঁরা অনুসরণ করেছেন তাঁরা ফল পেয়েছেন l তাঁর ছবিতে লোকেশনও যেন একটা চরিত্র l অনেকেই ভাবেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের পুরুলিয়ায় জন্মস্থান বলেই, বারবার এখানে এসেছেন ছবি বানাতে l এটা খুবই বোকা বোকা ভাবনা l ছবির প্রয়োজনেই তাঁর পুরুলিয়ায় আসা l ওনার কথায় পুরুলিয়ায় ছবি বানানোর উপযোগী জায়গা l বিভিন্ন ঋতুতে তার রূপ বদলায়, রং বদলায় l ক্যামেরা পাতলেই যেন ফ্রেম তৈরী l স্টুডিওতে সেট ফেলে ছবি করা তাঁর পছন্দ ছিলনা l আউটডোরে ছবি তৈরী করতে তিনি পছন্দ করতেন l ‘দূরত্ব’ থেকে ‘উড়োজাহাজ’-এ এই সত্যতার প্রমান মেলে l তাঁর ছবিতে লোকেশন যেভাবে ধরা পড়েছে, তা থেকেই বোঝা যায় লোকেশনের গুরুত্ব l বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আগে পুরুলিয়াকে তেমন ভাবে লোকেশন হিসেবে কেউ গুরুত্ব দেননি l সে অর্থে তিনিই যেন পুরুলিয়াকে নতুন করে আবিষ্কার করলেন। তারপর বাংলাতো বটেই, মুম্বাই থেকেও চলচ্চিত্র পরিচালকদের নজর পড়েছে পুরুলিয়ার দিকে l ‘উত্তরা’ থেকে ‘মন্দ-মেয়ের- উপাখ্যান’, ‘জানালা’, ‘ত্রয়োদশী’, রবীন্দ্র কবিতার চিত্রায়ন, ‘ওহ’, কিংবা ‘টোপ’ সর্বত্রই লোকেশন তার নিজস্ব চরিত্র নির্মাণ করেছে l তাঁর বিভিন্ন ছবিতে ব্যবহৃত ঘর, বাড়ি, রাস্তা, রেললাইন, জঙ্গল, স্টেশন, স্কুলবাড়ি, পুকুর, নদী, জলাধার, জীবনযাত্রা সব যেন মিলেমিশে একাকার l এসব খুঁজে পেতে কত মানুষের আবেগ আর ভালোবাসাকে আশ্রয় করতে হয়েছে, তা ভাবলে অবাক হতে হয় l এই দেশে এসব প্রাকৃতিক সম্পদের তেমন গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা নেই l তাই তথাকথিত উন্নয়নের প্যাঁচে সে সব সম্পদ বেমালুম নষ্ট হচ্ছে রোজ l রাষ্ট্রের কোন দায় নেই এসব সম্ভারকে রক্ষা করার l

ছবি : গুগল
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবিকে ঘিরে বিপুল কর্মকান্ড সংগঠিত হত l সিনেমার পর্দায় যে সামান্য দৃশ্যটুকু দেখি, তা নির্মাণে কত মানুষের শ্রম, মেধা, আবেগ ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে তার কোন হিসেব নেই l এসব করতে গিয়ে কত না মজাদার ঘটনার সাক্ষী থেকেছি l ‘উত্তরা’র শুটিং চলছে একটি গ্রামের বাইরের মাঠে l কাছেই একটি মন্দির l হাজারো লোকের ভিড়ে গিজগিজ করছে চত্বর l এরই মধ্যে একটা উড়ো চিঠি এলো বুদ্ধদার হাতে l চিঠিতে লেখা মন্দিরের জাগ্রত দেবী স্বপ্নাদেশ দিয়েছেন এক গ্রামবাসীকে, শ্যুটিংয়ের জন্য তাঁর শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে l সুতরাং, ছাগ বলি দিয়ে দেবীর পুজো করতে হবে l এটাই কয়েকদিন গোটা ইউনিটের কৌতূকের বিষয় হয়ে উঠলো l কিন্তু বেচারা ভক্তদের মনের সাধ সে যাত্রায় মেটেনি l আবার শ্যুটিংয়ের দরকারে হাইওয়ের উপরের কালী মন্দিরকে সরিয়ে দেওয়ায় এক ভণ্ড সাধু বেজায় ক্ষেপে ছিল আমাদের ওপর l শেষমেশ ঐ সাধুকে কিছু দক্ষিনা দিতে হয়েছিল আমাদের l এইরকম বেশ কিছু কৌতুক মিশ্রিত ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন সময় l আবার অতি উৎসাহী জনগনের উৎসাহের আতিশয্যে আমাদের শুটিং ভেস্তে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে l একবার শহর সংলগ্ন একটি গ্রামে আমরা পৌঁছতেই সেখানে মানুষের ঢল নামলো l বিরক্ত পরিচালক ততক্ষনাৎ লোকেশন প্যাক-আপের ঘোষণা করলেন l ‘উত্তরা’ ছবিতে গ্রামের মানুষের বাইস্কোপ দেখার একটি দৃশ্য ছিল l আমাদের জুনিয়ার আর্টিস্টদের সঙ্গে স্থানীয় উৎসাহী জনগণ মিশে গিয়ে, শুটিংকেই ভেস্তে দেয় l কেননা অপেশাদার শিল্পী অনেকসময় অদ্ভুত আচরণ করে বসে l ভিড়ের দৃশ্যও কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ, কিন্ত শুটিং দেখতে আসা জনগনের নির্দেশকের নির্দেশ শোনার কোন দায় নেই l ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে l পরে আবার ঐ দৃশ্যটি শ্যুট করা হয় l তখন ফিল্মে শ্যুট হতে খরচ হত বিস্তর l
পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ছিলেন কাজের ব্যাপারে খুবই খুঁতখুঁতে প্রকৃতির l তাঁর ছবিতে শেষ বিকেলের ম্যাজিক্যাল আলোর ভূমিকা ফিরে ফিরে এসেছে l সেই মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দি করতে চলতো যুদ্ধকালীন তৎপরতা l তারই মধ্যে কিছু ভ্রান্তি থেকে যেত কোনো কোনো দিন l সেসব ফেলে দেওয়া ছাড়া কোন গত্যান্তর ছিলনা পরিচালকের।
তাই ‘উত্তরা’র চার্চ পোড়ানো কিংবা ‘জানালা’ ছবির শেষ দৃশ্য দুবার শ্যুট করতে হয় পরিচালককে l ছবির এডিটিং পর্বের পরেও পুনরায় শ্যুট করেছেন পুরোনো দৃশ্যের l সিনেমার সঙ্গে তিনি আপোষ করতে চাননি l
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবি মানেই দীর্ঘদিনের শুটিং সিডিউল l মাসাধিক সময় ধরে শুটিং চলতো l প্রতিদিন সবার কাজ না থাকলেও, লোকেশন ছেড়ে তাঁদের যাওয়া যাবেনা l সবার জন্যই এক নিয়ম l একদিনের কাজ হয়ে হয়তো কয়েকদিনের বিরতি, তবুও থাকতে হবে l টালিগঞ্জ এর এক প্রতিষ্ঠিত নায়ক বিরতি চলাকালীন কলকাতা ফিরতে চেয়েছিলেন অন্য কাজের জন্য l অসন্তুষ্ট পরিচালক তাঁকে তাঁর ছবির কাজ থেকেই বিদায় নিতে পরামর্শ দিয়েছিলেন l শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর ছুটি মেলেনি l এ ক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি, ছবির চরিত্র নির্মাণে, অভিনেতার চরিত্রের মধ্যে যাপন একটি বড় প্রক্রিয়া l এই প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে গিয়ে অভিনেতা অন্য কিছু করলে চরিত্র নির্মাণ ব্যাহত হয় l তাঁর বিশ্বাস, এতে ছবি ক্ষতিগ্রস্ত হয় l পরিচালক হিসেবে তিনি আপোষের পথে হাঁটেননি l
এভাবেই তাঁর সাহচর্যে ঋদ্ধ হয়েছি নানাভাবে l শুধু যে শিল্প চর্চায় সমৃদ্ধ হয়েছি তা নয়, আমার ব্যক্তি জীবনে, পারিবারিক জীবনেও তাঁর প্রভাব অনেকখানি l আমার কিঞ্চিৎ থিয়েটার চর্চাকে উৎসাহ জুগিয়ে গেছেন বরাবার l আমাদের ‘অন্যচোখে’র নাট্যউৎসবে উপস্থিত থেকে আমাদের উজ্জীবিত করেছেন l
তিনি আমাদের মেধা-মনন উজাড় করে দিয়ে গিয়েছেন দুহাত ভরে l সে অর্থে তিনি আমাদের শিক্ষক l কিন্তু আমরা গ্রহন করতে পেরেছি কতটুকু? এই সভ্যতা, সংস্কৃতি যতদিন থাকবে আমাদের তাঁর নির্মিত ছবি গুলোর কাছে বারে বারে ফিরে যেতে হবে— নিজেদের জীবনবোধে উদ্দীপ্ত হতে, নিজেদের সংকটকে চিনে নিতে l
‘ওর কাছে গিয়ে বসলে ছায়া নেমে আসবে মনে হয়
ও দেবে না নেবে?
ও কি আশ্রয়, না কি আশ্রয় চায়?
আমার সামনে দিয়ে হেঁটে যায় ওই এক মেঘের মতো মানুষ
ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও হয়তো কোনদিন
হতে পারি মেঘ ‘ l
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Comments