//azoaltou.com/afu.php?zoneid=3651748 //azoaltou.com/afu.php?zoneid=3683887
top of page
Search

লোকশিল্পের নান্দনিকতা


স্বর্ণালী দত্ত

‘লোক’ শব্দটা একটা ছোট্ট শব্দ হলেও অর্থ এর অনেক বিস্তৃত। এই ‘লোক’কে কোনো বিশেষণে জোড়া যায়না। বড় লোক, ছোটলোক, ভদ্রলোক, মন্দলোক, মোটালোক, খাটোলোক এইরকম কোনো লোক নিয়ে ‘লোকসমাজ’ নয়। এই ‘লোক’ কোনো একজন নয়, একটা সমষ্টি, একটা গোষ্ঠী বা দল। এদের মধ্যে একটা সমন্বয় আছে, বাঁধন আছে। এই ‘লোক’রা একই রকম আনন্দ করে, একই রকম তাদের প্রকাশ, অভিবাদন। এরা যুগ যুগ ধরে একই ঐতিহ্যবাহী। ফলে এদের আলাদা এক মধুর সংস্কৃতি আছে যা এদেরকে বৃহত্তর সমাজ থেকে আলাদা করেও সেই সমাজের সঙ্গেই আবার একাত্ম করে দিয়েছে।


লোক-সমাজের সংস্কৃতিগত এই আনন্দ-পরিতৃপ্তির উদাহরণ কোনো না কোনো অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। কারণ কোনো অনুষ্ঠান বা কার্য-কারণ ছাড়া কোনো লোকশিল্প নেই। মানে এই দাঁড়ায় যে, ‘লোক’ তার অভ্যেস বশতই শিল্প তৈরি করে, এটা তার দৈনন্দিন কাজের মধ্যেই পড়ে। এটা একদিকে যেমন তার সমাজের অনেকের জন্য, অনেকের সঙ্গে তাকে করতে হয়, তেমনই তিনি নিজেও ব্যক্তিগতভাবে ঐ সকল সামাজিক প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠানের অংশীদার। সুতরাং কথা এই যে লোকশিল্প সামাজিক প্রয়োজনে কিম্বা ধরা যাক ব্যক্তিগত সৌন্দর্যচেতনার কারণে যাই হোক না কেন, তা সর্বজনীন এবং সমাজের সকলেই তা রস উপলব্ধি করে। লোকশিল্পের মজাটা হল, এখানে হুবহু অনুকরণের জায়গা নেই। শিল্পীর মনের গভীরে যে সহজ সরল ভাব ও গুন লুকনো থাকে তাই প্রকাশ পায় তার শিল্পে। ফলে মন অনুযায়ী লোক শিল্প আলাদা হতে থাকে। সৃষ্টিতে, সৌন্দর্যে, রসে এক একটি শিল্প আলাদা আস্বাদ নিয়ে আসে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো ধর্মীয় বিষয়ে, অনুষ্ঠানের নিয়মে, বিশ্বাসের বাঁধনে, কৃতজ্ঞতায় এই শিল্পের প্রকাশ ঘটে। শুরু হয় খুব সাধারণ চাওয়া-পাওয়া দিয়ে কিন্তু শেষ হয় এক তূরীয় আনন্দে।


লোকশিল্প বিভিন্নভাবে, বলা ভালো বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পায়। প্রথমেই বলতে হয় ‘আলপনা’র কথা। লোকশিল্পে ‘আলপনা’ খুব গুরুত্ব পায়। মানুষের মনের ইচ্ছা পুজ্য দেবতার সামনে এই আলপনা দিয়ে তুলে ধরা হয়। ঘরের মেঝে, দেয়ালে বা উঠোনে পিটুলীর গোলা দিয়ে তৈরি হয় নানান নকশা। আলপনা দিতে দিতে মেয়ে-বউরা ছড়া কাটে – “ আমি আঁকি পিটুলির গোলা/আমার হোক ধানের গলা।/আমি আঁকি পিটুলির বালা/আমার হোক সোনার বালা ” ( সেঁজুতি ব্রত)। লক্ষ্মী পুজোর আলপনায় লক্ষ্মীর পা, ধানের গোলা, ধানের শীষ, পেঁচা আজও অটুট আছে। পদ্ম, সূর্য, নানা ধরনের লতার মোটিফ আলপনায় সবসময় ব্যবহার হয়। লতার মধ্যে শঙ্খ, কলসি, খুন্তি; বিভিন্ন কলকাজাতীয় নকশা আলপনায় আলাদা মাত্রা এনে দেয়। শহুরে জীবনে অভ্যস্থ আমরা নিজেদের ‘নাগরিক’ আর ওদের ‘প্রান্তিক’ বলে আলাদা করলেও আমাদের মধ্যে এই ‘সো কল্ড’ - ‘প্রান্তিক’ টানটা রয়েই গেছে। আসলে আমরাতো এই মাত্র তিনশ-সারে তিনশো বছর হল নগর তৈরি করেছি, তাও ধীরে ধীরে। আমাদের শিরায় বয়ে চলেছে গোবিন্দপুর-সুতানুটি গ্রাম। তাই জন্যই বাড়ির পুজো হোক বা বারোয়ারী, উৎসব হোক বা বিয়ে, আলপনা আমদের শিকড়ের টানে নাড়া দেয়। অজান্তেই এঁকে ফেলি সেই পদ্ম, ধান, লতা, কলকা আরও কতকি। কিছুদিন আগে একটা প্রেজেন্টেশানে দেখলাম, কলকাতার এক নামি রেস্তোরায় দেয়ালের বিমে আঁকা হয়েছে ‘খুন্তিলতা’ মোটিফ। জেনেও ভালো লাগল, আমাদের সেই আদি ঐতিহ্য লোকশিল্পের সঙ্গে আমাদের নাগরিক মনের বাঁধনকে মজবুত করতেই স্থাপত্যশিল্পীর এই প্রয়াস।

লোকশিল্পের আর একটা উদাহরণ খুব উল্লেখযোগ্য, তা হল ‘উল্কি’। ‘উল্কি’ চিহ্ন শরীরে ফুটিয়ে তোলা সারা বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত আদিম রীতি। একসময় এই ‘উল্কি’ ছিল মানুষের অস্তিত্বের পরিচয়। তারা কোন গোষ্ঠীর লোক সেই চিহ্ন ছিল উল্কি। এখন বিবর্তনের মাধ্যমে উল্কি হয়েছে ট্যাটু। এই ট্যাটুর কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই। ফলে নিজের নাম, পরিবারের নাম, প্রিয় কোন লেখা, ফুল, পশু, ব্যক্তি থেকে শুরু করে কৃষ্ণের বাঁশি, ময়ুর পালক সবই বলা চলে মডার্ন ‘উল্কি’র নকশা। আমরা তো এই ‘উল্কি’কে খুব আদরে গ্রহণ করেছি স্টাইল হিসাবে ; অতীতকে না জেনেই আধুনিক হওয়ার ঢঙে।


শিল্পীদের তৈরি মাটির ঘোড়া, কাঠের পেঁচা, পট চিত্র, নকশা পাখা, ডোকরার জিনিস সবই আমাদের সফিস্টিকেটেট বৈঠকখানার শোভা বর্ধন করতে অগ্রগণ্য। সারা বছরই এদিক ওদিক মেলা হচ্ছে, পাওয়া যাচ্ছে বাংলা জুড়ে লোকশিল্পীদের তৈরি করা নানান সামগ্রী। তার মধ্যে থেকেই আমরা ঘরে নিয়ে আসছি ‘মাটির ঘোড়া’। ঘরের কোণে সাজিয়ে রাখছি। অতিথিরা দেখছে আর বাহবা দিচ্ছে। আমরা জানতেই পারছিনা এই ঘোড়াকে আসলে ‘ছলন পুতুল’ বলা হয়। দেবতার বাহনের প্রতীক। ‘লোক’রা দেবতার থানে ( যতদূর সম্ভব ধর্মঠাকুরের কাছে) এই মাটির ঘোড়া দিয়ে আর্জি জানিয়ে যায় যাতে দেবতার আসল ঘোড়া তার ঘর-সম্পত্তি পাহারা দেয়। এরপরেই আমরা পছন্দ করি পেঁচাকে । মানে পেঁচার পুতুল (বর্ধমানের নতুন গ্রাম এর তৈরি), এই পুতুলের ডিজাইন দিয়ে সোফাসেট, মোড়া; পেঁচার মোটিফ দেয়া শাড়ী ইত্যাদি ইত্যাদি। এই পেঁচাও তো আঁকা হতো মাঙ্গলিক অর্থে, কিন্তু আমরা একে নিয়ে এসেছি অর্থ-মুক্ত করে শুধু মাত্র সৌন্দর্য বাড়াতে। ডোকরার জিনিসও তাই। শিল্পী তৈরি করেছে তার কোনো এক ঐতিহ্য মাথায় রেখে কিন্তু আমারা গ্রহণ করেছি নিজেদের ভালোলাগা ও ভালবাসা দিয়ে। পটের একটা আলাদা গল্প আছে। পুরাণের গল্প, মঙ্গলকথা, মনসার ভাসান, কৃষ্ণকথা এইসব পটে এঁকে পালাগানে দেখানো হয়। আমরা খুব সহজেই ঘরের দেয়ালের অবস্থানটা একবার ভেবে নিয়ে মানানসই পট চিত্র কিনে এনে লাগিয়ে দি। তেমনই পছন্দ করি পালা গানের লোকচিত্র, অরলি আর্ট বা মধুবনী লকচিত্রে আঁকা শাড়ী, টিশার্ট, পাঞ্জাবী, চাদর, ওড়না, টেবিল ক্লথ। কোনটায় আঁকা বিয়ের গল্প, চাষের কাজের গল্প, দৈনন্দিন কথন, আবার কোনটায় আঁকা মাৎস্যন্যায়ের মতো কঠিন বিষয়।


এই লোকশিল্পগুলির লোকগোষ্ঠীর মধ্যে একটা অর্থ আছে, আগেই বলেছি যে এগুলি প্রধানত কোন অনুষ্ঠানের সূত্রে তৈরি হয়েছে। কিন্তু শহুরে আভিজাত্যে যখন সেটাকে গ্রহণ করছে বা ‘রিসাইকেল’ করছে তখন সেটা তার পুরনো কার্য থেকে মুক্ত হয়ে যাচ্ছে। নতুন কোন কার্যতে যুক্ত হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তবে এই বেড়িয়ে আসার ফলে লোকশিল্প তার রূপ বদলাচ্ছে। বলা যায়, কিছুটা যুগের তালে আবার কিছুটা পেটের দায়ে। লোকশিল্পের মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনে যে অতীতচারিতা বা আদি মন কাজ করে, যে সরল আনন্দের অনুভূতি পাই্‌, তা ঐ ‘লোক’দের ‘জীবনানন্দ’। আসলে তাদের সঙ্গে আমাদের মূল সংযোগটা তো এক। শিল্প তৈরি, কেনা-বেচায় শিকড়ের প্রতি টানই সাড়া দেয়। তাই লোকশিল্প এখন আর কোনো নির্দিষ্ট জায়গার হয়ে সীমাবদ্ধ নেই। শহরের সংস্কৃতি, নান্দনিক মন একে বৃত্তের বাইরে নিয়ে এসেছে। তৈরি হয়েছে ‘মিক্সড ফোক’-এর কনসেপ্ট। তথাকথিত এলিট সমাজের ঘরগুলি, (বিশেষ করে ঐ বৈঠকখানার কথা বলেছিলাম একেবারে শুরুতেই) এগুলো সুন্দর করে সাজচ্ছে সব রকমের, সব জায়গার লোকশিল্প দিয়ে। কারণ, লোক সংস্কৃতির এমন একটা সুরকরণ আছে, মায়া , দৃশ্যপট আছে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের অনেকদিনের স্মৃতি আমাদের বর্তমানকে ধাক্কা দেয়। তার জন্যই আমরা একে আমাদের শহুরে নন্দনতত্ত্বে সহজেই অন্তর্ভুক্ত করতে পারছি।

 
 
 

Comentarios


Subscribe to Site

Thanks for submitting!

© 2020 Bhaan Theatre | Designed by Capturegraphics.in
bottom of page