শিব ও এবং তার তাণ্ডব নৃত্য নিয়ে বিস্তারিত কথা পাড়লেন - শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
- Avijit Mitra
- May 30, 2021
- 3 min read
Updated: Jun 3, 2021

শ্রীপর্ণা ভট্টাচার্য
নটরাজ ও তাণ্ডব নৃত্য

ছবি : গুগল
ভারতীয় নৃত্যে নটরাজ শিবকে নৃত্যের স্রষ্টা বলা হয়। তিনি মহাজাগতিক নৃত্যের স্রষ্টা, সনাতন শক্তির উৎস। পঞ্চক্রিয়ায় তিনি নিজেকে প্রকাশ করেছেন। এই পঞ্চক্রিয়া হল- সৃষ্টি, স্থিতি, লয়, তিরোধাম ও অনুগ্রহ । পঞ্চক্রিয়ার অধিদেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মহেশ্বর ও সদাশিব।
“আঙ্গিকং ভুবনং যস্য বাচিকং সর্ববাত্মায়ম্।
আহার্ঘং চন্দ্রতারাদি ত্বং নমঃ সাত্তিকং শিবম্”।।
অর্থাৎ, এই ভুবন তাঁর অঙ্গ। তাঁর মুখ নিসৃত ওঁঙ্কার ধব্বনি সমগ্র জগতের শব্দ সৃষ্টির মূলে। চন্দ্র-তারা তাঁর অলঙ্কার ।সেই ত্রিকালজ্ঞ সাত্ত্বিক শিবকে জানাই প্রণাম।
নটরাজ বেশে শিবের মূর্তি অত্যন্ত জনপ্রিয়। ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকেই নটরাজ মূর্তি কল্পনায় একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। কথিত আছে নৃত্য ও সঙ্গীত শিবের সৃষ্টি। তিনিই নৃত্যকলার প্রর্বতক। পৌরাণিক যুগ থেকেই নৃত্য ও সঙ্গীতের সঙ্গে শিবেযোগ বিদ্যমান। এই শিব অর্থাৎ নটরাজ সৃষ্টি ও ধ্বংসের দেবতা । তিনি রজঃ গুনে সৃষ্টি করেন, সত্ত্ব গুনে পালন করেন এবং তমঃ গুনে ধ্বংস করেন।

ছবি : গুগল
নটরাজের দক্ষিণ হস্তের ডমরু সৃষ্টির প্রতীক, ডমরু ধ্বনির সঙ্গে মহাপ্রান পঞ্চভূতের যোগ আছে। বৈচিত্র্যমান বিশ্বের উপাদান পঞ্চভূত।বাম হস্তে অগ্নি ধ্বংসের প্রতীক ।দক্ষিণ হস্তের অভয় মুদ্রা পালনের প্রতীক । এবং বাম হস্তের লতা মুদ্রার অর্থ হল তাঁর চরণে আশ্রয় নিলেই চিরমুক্তি ।পিছনে চক্রাকারে অগ্নিগোলক ওঁ-কারের প্রতীক, বিশ্বের ও বিশ্ববাসীগণের প্রান শক্তির পরিচায়ক। কপালে অর্ধচন্দ্র অর্থাৎ অগ্নি জ্ঞানের এবং শিরে সর্প প্রকৃতি মানে প্রানশক্তির পরিচায়ক এবং জটাজাল নৃত্যের ছন্দে শূন্যে উৎক্ষিপ্ত-গঙ্গা হিমালয় গোমুখের দিকে বাহিত হয়। পদতলে অপস্মর নামক মায়ারূপী দৈত্যকে দলিত করে অর্থ্যাৎ অজ্ঞানকে বিনাশ করে মুক্তি ও শান্তির আলোকদান করেছেন। দৈত্য বা বামন পদ্মপীঠের উপর শুয়ে আছে।তাঁর এক কর্ণে পুরুষ ও অন্য কর্ণে নারীর ভূষণ প্রমান করে তিনি একাধারে পুরুষ ও প্রকৃতি। তবে নৃত্য ছাড়াও ভারতীয় শিল্প, ভাস্কর্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে নটরাজ শিব মূর্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত আছে।
কথিত আছে, নটরাজ শিব একবার তাঁর ভক্তদের পরীক্ষার জন্য ছদ্মবেশে দক্ষিণ ভারতের তিল্লাই নামক স্থানে উপস্থিত হন, এবং উপস্থিত ঋষিদের তর্কে নটরাজ পরাজিত করেন তাঁদের।ঋষিগণ তখন ক্রুদ্ধ হয়ে যজ্ঞ শুরু করেন এবং যজ্ঞাগ্নি থেকে এক বাঘ বার হয়ে শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে হত্যা করে বাঘের চর্ম পরিধান করে নেন। তখন আবার যজ্ঞ শুরু হয় ।এরপর যজ্ঞ থেকে সাপ বার হয়ে শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে অঙ্গের ভূষণ করে নেন ।এরপর যজ্ঞ থেকে বামনাকার দৈত্য শিবকে আক্রমণ করলে শিব তাকে ঊর্দ্ধে নিক্ষেপ করেন এবং ভূমিতে পতিত হলে তাকে পদতলে রেখে আনন্দে নৃত্য শুরু করেন। তখন ঋষিগণ তাঁকে চিনতে পেরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং নটরাজ তাঁদের আশীর্বাদ করে বলেন যে তিনি এইস্থানে আবার আবির্ভূত হবেন।

ছবি : গুগল

ছবি : গুগল
এই স্থানেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিদাম্বরমের বিখ্যাত নটরাজ মন্দির।এছাড়া নটরাজ দৃশ্য এলিফেন্টা গুহাগাত্রে দেখা যায়।

ছবি : গুগল
নৃত্যের প্রথম প্রকাশ তাণ্ডব নৃত্য । নটরাজ শিব এই তাণ্ডব নৃত্যের স্রষ্টা। কথিত আছে ত্রিপুরাসুরকে বধ করার সময় দেবাদিদেব মহাদেব বীর ও রৌদ্র রসের সংমিশ্রণে যে নৃত্য করেন তাই হল তাণ্ডব। আবার শোনা যায়, শিব অঙ্গহার রেচক পিন্ডি সৃষ্টি করে তণ্ডুকে শিক্ষা দেন এবং তণ্ডু সেই নৃত্য কণ্ঠসঙ্গীত ও যন্ত্রসঙ্গীত সহকারে পরিবেশন করেন।সেই নৃত্যই হল তান্ডব নৃত্য ।বিভিন্ন সময়ে অনুসারে নটরাজের নৃত্যকে সাতটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তা হল-
১) আনন্দ তাণ্ডবঃ-সৃষ্টির আনন্দে নটরাজ শিব যে নৃত্য করেছিলেন সেই নৃত্যই আনন্দ তাণ্ডব। এই নৃত্য শিবের অনুগামীদের রক্ষা করার জন্য। দক্ষিণ ভারতের চিদাম্বরম্ অথবা তিল্লাই মন্দিরের ব্রোঞ্জের মূর্তির মধ্যে ভাস্কর্যের মাধ্যমে অমর হয়ে আছে। এই নৃত্যের মাধ্যমে আত্মিক প্রসন্নতা, মোক্ষ প্রাপ্তি প্রভৃতি ভাব প্রকাশ পায়।

ছবি : গুগল
২)উমা তাণ্ডবঃ- নটরাজ শিব ও উমার দাম্পত্য প্রেম প্রদর্শিত করবার জন্য যে নৃত্য তাই হল উমা তাণ্ডব ।
৩)সন্ধ্যা তাণ্ডবঃ- জীবনসূর্য অস্ত হওয়ার পর অন্ধকাররুপী মৃত্যু জীবনকে গ্রাস করে , সন্ধ্যা তাণ্ডব সেই রূপেরই প্রকাশ ।এতে প্রথমে করুণ রস ও ক্রমে ক্রমে রৌদ্র ভয়ানক ও বীভৎস্য আদি রসের প্রকাশ পায়।
বহু প্রাচীনকালে উল্লিখিত আছে যে তুষারবৃত কৈলাস পর্বতে তিনটি বিশ্বের মাতা স্বর্ণ সিংহাসনে উপবিষ্ট আছেন, যখন তৃতীয় বিশ্ব দিনকে দীর্ঘ কালস্থায়ী এবং রাত্রের আসন্ন অন্ধকারময়তার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে শূলপাণী(শিব)কে স্বর্গীয় ঘটনার জন্য নৃত্য পরিবেশন করতে অনুগ্রহ করেন।
সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন ,
ইন্দ্র বাঁশী বাদনরত,
ব্রহ্মা ছন্দময়তাল বজায় রাখছেন,
রামভগবতী সঙ্গীত পরিবেশন করেন,
বিষ্ণু ড্রাম বাজাচ্ছেন ,
সকল দেবতা চতুর্দিক ঘিরে স্বর্গীয় বাদ্যযন্ত্রবাদন শ্রবণ করে দেবতার নিকট প্রার্থনা করছেন।
ভগবান মৃদানিপতি নৃত্য প্রদর্শন করছেন।
ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে- এই নৃত্য সকলকে রক্ষা করে।

ছবি : গুগল
৪)গৌরী তাণ্ডবঃ- মহাদেব গৌরীর প্রতি আকর্ষণবশতঃ যে নৃত্য করেছিলেন, তাই গৌরী তাণ্ডব।এই নৃত্যে আদি শক্তির প্রতি সাত্ত্বিক ভাব প্রদর্শিত হয়। এর বোল শ্রুতি মধুর ও অঙ্গ সঞ্চালন মন্থর হয়।
৫)ত্রিপুরা তাণ্ডবঃ- ত্রিপুরাসুরের অত্যাচারে যখন ত্রিজগত প্রপীড়িত তখন অসুরকে বধ করার জন্য শিব যে নৃত্য করেছিলেন তাঁকে ত্রিপুরা তাণ্ডব বলে। অন্ধকারকে নাশ করাই ত্রিপুরা তাণ্ডবের উদ্দেশ্য। এই তাণ্ডবের বোল আড় ও বিয়াড় লয় যুক্ত।
৬) সংহার তান্ডবঃ- নটরাজ শিব একাধারে সৃষ্টি ও সংহারের দেবতা । সংসারে পাপের মাত্রা বেড়ে গেলে ভগবান শিব রূপ ধারণ করে সৃষ্টির বিনাশের হেতু সংহার তাণ্ডব করেছিলেন। তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে নির্গত অগ্নি শিখায় জড় ও জীব সকল ধ্বংস হয়ে নূতনের সৃষ্টি করেন।
৭) কালিকা তাণ্ডবঃ- দেবী চণ্ডীর তৃতীয় নেত্র থেকে সৃষ্ট মহাকালীর দৈত্য নিধনই কালিকা তাণ্ডবের বর্ণিত বিষয়। এর বোল ভীষণতাময়। এটা লাস্য নৃত্যকলার অপূর্ব নিদর্শন।

ছবি : গুগল
Make a Donation
A/C: 40910100004585
IFSC Code:BARB0BUDGEB
Bank Name: Bank Of Baroda
Name in Bank: BHAAN
Comments