সদ্যপ্রয়াত দিলীপ কুমার কে 'সাগিনা মাহাত' রূপে স্মরণ করলেন - শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়
- Sneha Roy
- Aug 3, 2021
- 4 min read

শুভজিৎ মুখোপাধ্যায়
সাগিনা চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভাইও, সাথীও…’
সাগিনা’র কথা বলতে গেলে দ্বন্দ্ব আসে মনে। এই দ্বন্দের ঘোরে আমাদের খুঁজে বার করতে হয় এক অতীতকে। যে অতীত বিশ্বাসের, লড়াইয়ের। বিশ্বাসঘাতকতার, লড়তে লড়তে মরে যাওয়ার। মৃত্যু মৃত্যুই। এর কোনো কম্পেনশেশন হয়না। তাকে কোনো তাত্ত্বিক মোড়ক না দেওয়াই ভালো। বিশেষ করে যখন সাগিনা’রা মারা যায়। রূপদর্শী তাঁর গল্পে সাগিনার মৃত্যু দেখালেও তপন সিংহ তা করেননি। বরং সাগিনা তাঁর প্রিয়তম বন্ধুর মৃতদেহের সামনে আজীবন লড়াইয়ের শপথ নিচ্ছে সিনেমার পর্দায়। সাগিনা’র মৃত্যু মেনে নেওয়া যায়না। কারণ সাগিনা আমাদের বঞ্চনার প্রতিশোধ নিতে বদ্ধপরিকর। ও আমাদের বেঁকে যাওয়া মেরুদণ্ডে শিরশির করে বয়ে চলা ঠাণ্ডা হাওয়া। আমাদের ইনকিলাব। সাগিনা, সাগিনা মাহাতো।

১৯৪২-৪৩ সালের শ্রমিক আন্দোলনের হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯২০-২২ সালের খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সিলেটের চারগোলা উপত্যকার চা-বাগান ছেড়ে দল বেঁধে শ্রমিকরা চলে যেতে লাগলে তাঁদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করে ২১ সালের মে মাসে ইস্ট বেঙ্গল রেলওয়ে ও চাঁদপুর স্টিমার সার্ভিসের কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করে। এরপর ১৯২৭ সাল থেকে একে একে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠিত হতে আরম্ভ করে অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন কল-কারখানায়। আমাদের দেশের চা-বাগান গুলোতে যে সমস্ত ইউনিয়ন সে সময় সংঘটিত হয়েছিল প্রত্যেকটিই কমিউনিস্ট পার্টির মদতে ও মতাদর্শে পরিচালিত হত। প্রধানত ছোটনাগপুর থেকে উঠে আসা আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্য থেকেই চা-বাগানের শ্রমিক নিয়োগ করা হত। স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান কর্মী থাকলেও এই ছিন্নমূল আদিবাসীদেরই কেউ কেউ হয়ে উঠত মজদুর নেতা। যেমনটা এ আখ্যানে সাগিনা।

আমাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, পরিচালক তাঁর গল্পের পটভূমি বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটি অধ্যায়’ –এর কথা। ক্ষমতালোভী শাসক দের বিরুদ্ধে বিশ্বজোড়া সংগ্রাম একদিকে, অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অন্তিম নাভিশ্বাসের ঘূর্ণ্যাবর্তে জন্ম নিচ্ছিল নতুন ভারত। সেই ভারতের প্রতিনিধি হিসেবে উঠে এল রেল কারখানার শ্রমিকেরা। আর তাঁদের নেতা সাগিনা। ‘শ্রমিক নেতা’ বলতে কাগজে-কলমে যেমন ছবি ফুটে ওঠে সাগিনা মোটেও তেমন ছিল না। ওঁর স্বভাব ছিল ‘রবিনহুড’। মার কা বদলা মার, খুন কা বদলা খুন। আদ্যপান্ত মাতাল, অপরিণামদর্শী। এই সাগিনা পড়ালেখা করা, সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা কলকাত্তা-র বাবুদের নজরে পড়ল। সাগিনাও চেয়েছিল বন্ধুর মতো তাঁর কেউ হাত ধরুক, তাঁকে পথ দেখাক। তবে হয়ত বুঝতে পারেনি ওদের পথ ভিন্ন। সাগিনাও অন্য অনেকের মতো স্বপ্নে দেখত হাসপাতাল, স্কুল, পেট ভরা ভাত আর শ্রমিকের সম্মান। ওঁর উচিৎ ছিল নিজস্ব ক্ষমতা দিয়েই সব আদায় করা। কিন্তু সাগিনাও বৃহত্তর সমাজ বদলের দ্বিধাগ্রস্ত লড়াইয়ে নিজেকে শরিক করে ফেলল। আদতে সেই রাজনীতিটার দরকার ছিল একটা লড়াইয়ের মুখ, যাকে শিখণ্ডী করে মানুষের বিশ্বাস কুড়োতে পারে। ফলে মানে না বুঝেও সাগিনা আওড়ে যেত ‘দাস ক্যাপিটাল’, ‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’-র অমৃতবাণী। যেমনটা উপরওয়ালাদের নির্দেশ থাকত আর কী!
অমন দুর্বোধ্য যত শব্দ সাগিনা ব্যবহার করেছে তত ওঁর প্রিয় সাথীদের থেকে দূরে চলে গেছে। তত্ত্ব আর সাধারণ জীবন যে কতটা আলাদা তা যখন সাগিনা বুঝতে পেরেছে তখন ওঁর পিছনে কেউ নেই। না পার্টি না সাথীরা। এতদিন যারা সাগিনার ‘কামরেড’ ছিল তারা তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলছে। তাঁদের চোখে সে অপরাধী। ‘হত্যাকারীর পরিচালিত বিচারালয়ে’ বিচারের আগেই সে দোষী সাব্যস্ত। রশা প্রস্তুত, প্রস্তুত ফাঁসুড়ে। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পে রহস্যাবৃত মৃত্যুদিয়ে সাগিনার চ্যাপ্টার ক্লোজ করলেও তপন সিংহ তাঁর সিনেমায় দেখিয়েছেন উত্তরণের পথ। বলা যেতে পারে গল্পের সাগিনা’র মৃত্যুর পর থেকে সিনেমার সাগিনার এন্ট্রি। জনতা ঘেরা বিচার সভায় ক্ষমতার আকাঙ্খায় উন্মাদ এক স্বৈরাচারের সামনেও সে অকুতোভয়। কেবল ‘ছোটা ছোটা বাচ্চালোকের’ ভুখা পেটকে সে ভয় করে। সে বুঝতে পেরেছে যে স্রোতে সে ভেসেছিল তা ঠিক ছিল না। স্বীকার করতে তাঁর বাধে না। জীবনে ওঁর কোনো সমাজনীতি নেই, অর্থনীতি নেই। রাজনীতিতো নেইই। গৌরকিশোর ঘোষ তাঁর গল্পের সঙ্গে সিনেমাটির তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন। তাঁর মতে,
“ গল্পটা এত ভালো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধু লেখার দোষে একটা ভালো গল্প হয়ে দাঁড়াল না। অথচ এই গল্পেই আমি প্রথম আমার জীবনের অভিজ্ঞতাকে মেলে ধরতে চেষ্টা করেছিলাম। সত্যকে অনেক স্পষ্ট করে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। সাগিনার চরিত্রে যে একটা ভাব ছিল, দুর্দান্ত নেতৃত্ব ছিল, যৌন্তৃপ্তিতে তাঁর কোনো বাছবিচার ছিল না, তাঁর বিচার বিবেচনা বাহ্য জগতের শৃঙ্খলার ধার ধারেও না, মদের নেশা তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত এবং মারদাঙ্গায় সে পিছপা হত না, এই সব নিয়েই সাগিনা ছিল অতিবিশ্বস্ত এবং স্নেহপরায়ণ বন্ধুএবং একটা নিটোল মানুষ; এই ব্যাপারটা আমার গল্পে যতটা গভীরতা নিয়ে ফুটে ওঠা উচিত ছিল বলে আমার মনে হয়েছে, আমার গল্পটায় ঠিক তেমনভাবে এই চরিত্রটা ফুটে ওঠেনি।

আমার এই গল্প নিয়ে তপন সিংহ যে ফিল্মটা করেছিলেন… অভিনেতা দিলীপকুমার আশ্চর্য দক্ষতায় আমার খামতি মিটিয়ে দিয়ে সাগিনার চরিত্র অনেকটা কাছাকাছি চিত্রিত করে তুলেছেন। মজা এই যে, সাগিনার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমারই ছিল। তপন বা দিলীপ তাকে চোখেও দেখেননি। সৃষ্টি যে কোথায় কেমনভাবে হয় সেটা আমার কাছে রহস্যই থেকে গিয়েছে।“ (জিজ্ঞাসা, পূর্বোক্ত, পৃ ১১৩)
এই রহস্যের কোনো কুল-কিনারা নেই। তবুও কিছু কথা বলা যায়। ১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমায় দিলীপকুমার হিরো নন বরং চরিত্রাভিনেতা। মেথড অভিনয়ের এ এক অনন্য সংযোজন। ওঁর গলায় কণ্ঠী থেকে শুরু করে চেহারার গড়নে আদিবাসী সমাজের ছাপ, যাতে কারখানার শ্রমিকের দুর্গন্ধময় যাপনের চিত্র। আপনভোলা এই চরিত্রের কথা বলার ধরণ, নেশাতুর হেঁটে চলা আর শেষ পর্যন্ত দাঁত চেপে লড়ে যাওয়া যেভাবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তা বিস্ময়ের। সাগিনা’র চরিত্রে যে মেঠো রুক্ষতা দরকার ছিল তা রোম্যান্টিক হিরোর নয়। বরং দিলীপকুমারের স্বরে যে সাইলেন্স ছিল তা এক্ষেত্রে অনেক জরুরী ছিল বলে মনে হয়। এ সকলই আমার নিজস্ব ধারণা। আর সর্বোপরি নির্দেশক তপন সিংহ এর কথা বলা যায়। পুঁজিবাদের শোষণ এবং একই সাথে বিশেষ একটি মতবাদকে শেষ পর্যন্ত মানুষের বিচারালয়ে প্রত্যাখ্যান করার যুগলবন্দী সম্ভবত তিনিই দেখাতে পারেন। তাই হয়তো বাঙালী দর্শক ঋত্বিক – সত্যজিৎ - মৃণাল –এর সারিতে তপন সিংহ কে রাখতে লজ্জা পায়।
তবুও ইতিহাসের পাতায় সত্যিকার এক প্রান্তিক মানুষের, খেটে খাওয়া মানুষের উত্থানের গল্প বলার এই ‘সাগিনা মাহাতো’-র কথা থেকে যাবে। যেমন ভাবে থেকে যাবে সেই সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখা শিক্ষিত মানুষগুলোর বিশ্বাসঘাতকের কথা। অথবা সাগিনা নামক এক পাহাড়ী বিছের কথা, যে নির্দ্বিধায় বলতে পারে – ‘ভোলে ভালে মুরক মজদুর প্যাঞ্চা সওয়াল বুঝে না, শুধু পেটের সওয়াল বোঝে…’ অথবা তাঁর স্বীকারোক্তি – ‘হ্যাঁ খারাপ কাজ করেছি। অনেক খারাপ কাজ। আরে শালা সারা দুনিয়া খারাপ কাজ করে।‘ হিমালয়ের কোল ঘেঁষা খোলা মাঠে চিত হয়ে পড়ে থাকা দীর্ঘদেহীর শরীরে তাঁরই অন্তরঙ্গ পরিজনদের আঘাতের চিহ্ন, যে আঘাত তাঁর চিন্তা-চেতনাকে পুনর্জন্ম দিতে পারল। অথবা শুকনা ফরেস্টে রেলে কাটা দেহটা সযত্নে আঘাতের চিহ্নগুলোকে লালন করে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে পড়ল।
তবুও সাগিনা উঠে দাঁড়াবে। সমস্ত মজদুরকে এক করে নিয়ে আবার একটা মিটিং হবে পাহাড়ের কোলে। চারিদিকে স্লোগান উঠবে ‘শ্রমিক ফ্রন্ট জিন্দাবাদ’। ভেসে আসবে এক কামরেডের শেষ কথা – ‘তৈরি হও সাগিনা, সত্যিকারের লড়াইয়ের জন্য তৈরি হও…’ আর সাগিনা তাঁর আর্তনাদ চেপে তাঁর সাথে হয়ে যাওয়া ধোঁকাবাজীর প্রতিশোধ নিতে চিৎকার করে উঠবে – ‘ভাইও, সাথীও …‘
تعليقات