সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক তর্জা:কালচারের গোড়ায় পৌঁছোতে চাইলেন - প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়
- Sneha Roy
- Aug 3, 2021
- 10 min read

প্রতীপ চট্টোপাধ্যায়
রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনায় সাধারণভাবে দু-ধরনের সংস্কৃতির কথা বলা হয়- ক্রিয়াশীল সংস্কৃতি এবং নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতি| সমকালীন পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আলোচনায় মতাদর্শভিত্তিক বাম রাজনীতির নির্বাচনী অবক্ষয় এবং আবেগের আত্মিকতাভিত্তিক জনমোহিনী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর আলোকপাত করা হয়| নিষ্ক্রিয় বা নিষ্পৃহ রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে যখন ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন করানোর চেষ্টা হয় সেই সময় রাজনৈতিক তরজা এক গুরুত্বপূর্ণ আধার হিসাবে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের গণ-মাধ্যমে এবং পৌর সমাজে উপস্থিত| এই নিবন্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট থেকে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আত্মিকতার বিবর্তনে রাজনৈতিক-তরজার গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তার বিশ্লেষণের একটি প্রচেষ্টা|
রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলতে রাজনীতির প্রতি সমাজের ধারণা, বিশ্বাস, এবং দৃষ্টিভঙ্গির ও আচার-আচরণের অভ্যাসের সংমিশ্রনকে বোঝানো হয়| রাজনৈতিক সংস্কৃতি সমাজের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক ক্ষমতা কাঠামো এবং রাজনৈতিক দল ও তার নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গির ঐতিহাসিক বিবর্তনকে নির্ভর করে| অর্থাৎ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঐতিহাসিক, তুলনামূলক এবং বিশ্লেষনধর্মী বিষয় যা একটি নির্দিষ্ট সমাজের নির্দিষ্ট অভিজ্ঞতালব্ধ| তাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি কখনো খুবই ক্রিয়াশীল হয় যখন রাজনীতিকে সমাজ পরিবর্তনের আধার হিসেবে দেখা হয় আবার এই সংস্কৃতি অন্য সময়ে খুবই নিষ্ক্রিয় ও নিস্পৃহ হয়ে পড়ে যখন পরিবর্তনের আধার হিসেবে রাজনীতির আশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে ক্ষমতার অন্ধগলি থেকে পরিচালিত হতে থাকে|
ক্রিয়াশীল বা সক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মতাদর্শভিত্তিক| অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শের রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে সমাজের যে অংশের মানুষরা সেই দলকে সমর্থন করে তারা সরকারের সবকিছু সমর্থনে সক্রিয় হয় এবং সরকারের বিন্দুমাত্র বিরোধিতায় থাকে নিষ্ক্রিয়| আর সমাজের সেই অংশ যারা এই নির্দিষ্ট মতাদর্শের দলকে বিরোধিতা করে তারা সরকারের সবকিছুর বিরোধিতায় থাকে সক্রিয় কিন্তু সরকারের কোনোকিছুকে সমর্থনযোগ্য মনে করে না এবং তাই সমর্থনে থাকে তারা নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ| তাহলে দেখা যাচ্ছে ক্রিয়াশীল ও নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ বা একই বৃন্তের দুটি কুসুমসম| এখানে মনে রাখা দরকার পশ্চিম দুনিয়ার দেশগুলিতে রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে এতো জটিলতা, রং বদলানো বা দ্বিমুখীতা নেই| সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হলো পৌর-সমাজ যা রুচিশীল উদারবাদী মানসিকতার দ্বারা গঠিত এবং সরকার ও রাজনৈতিক দলের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম এবং সরকার পরিচালনের মূল আধার হিসেবে পরিষেবা প্রদানের কাজকেই বোঝানো হয় এবং সেখানে মুক্ত মনে সরকারকে সমর্থন বা বিরোধিতা করা হয় ব্যক্তি-নাগরিকের রাজনৈতিক মতাদর্শের উর্ধে উঠে এবং অন্ধ-বিরোধিতা বা অন্ধ-সমর্থনের জায়গায় দেখা যায় গঠনমূলক বিরোধিতা বা গঠনমূলক সমর্থন| অর্থাৎ বিরোধিতা করলে আলোচনার মাধ্যমে সরকারকে ভালো কাজ করার রূপরেখা প্রদান এবং সমর্থন করলেও সরকারকে আরো ভালো পরিষেবা প্রদানের নতুন দিক আলোকিত করা| পশ্চিম দুনিয়ায় এইটাই ছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিত্র বিংশ-শতাব্দী অব্দি| কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে পশ্চিম দুনিয়ার সমাজ যত বেশি মিশ্রিত সমাজ হয়ে উঠছে অভিবাসী এবং শরণার্থীদের নিয়ে ততো বেশি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যেও আসছে হিংসা এবং অস্থিরতা| পশ্চিমী রাজনৈতিক সংস্কৃতি হারাচ্ছে তার সৃজনশীলতা ও গাম্ভীর্য|
উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশগুলিতে অবশ্য বিংশ শতাব্দী থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতি অন্য পথে হেঁটেছে, যেখানে পৌর-সমাজের পরিবর্তে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়েছে রাজনৈতিক পরিচিতি, রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা| তাই ভারতের মতো উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়েছে দোদুল্যমান এবং অন্ধ-বিরোধিতা বা অন্ধ-সমর্থনের দোষে দুষ্ট| কিন্তু এর ফলে ভারতের মতো বিশাল দেশে যেখানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান, সেখানে রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে আকর্ষনীয় কারণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি এক এক অঙ্গ-রাজ্যে এক এক রকম এবং একই রাজ্যের মধ্যে বিভিন্ন জেলাগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কৃতি লক্ষ করা যায়| একথা ঠিক যে সমাজগতভাবে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠবে| তাই পশ্চিমী দুনিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির আদলে ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে না সে কথা বলাই বাহুল্য| কিন্তু দেশজ রাজনৈতিক সংস্কৃতিরও তো একটি নির্দিষ্ট স্বরূপ এবং বৈশিষ্ট্য থাকবে| এই জায়গাতেই ভারতের অভিজ্ঞতা অনন্য| ভারতের রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিবর্তনের ইতিহাসে যেমন পশ্চিম দুনিয়ার উদারবাদী ছাপ কিছু প্রাতিষ্ঠানিক জায়গায় লক্ষ করা যায় (মুক্ত গণ-মাধ্যম, বিচারালয় এবং মুক্ত পর-সামাজিক পরিসর), আবার কখনো কতৃত্ববাদী ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয় হয়ে ওঠে (১৯৭৫-এর জরুরি অবস্থা বা বর্তমান বি.জে.পি দলের নতুন ইতিহাস লেখার প্রচেষ্টা), কখনো আফ্রিকা মহাদেশের মতন দুর্নীতি ও স্বজন-পোষণের দৃষ্টান্ত তৈরী হয়(২০১১ সালের লোকপাল বিল নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ভারত আন্দোলন দ্রষ্টব্য) আবার কখনো এই সংস্কৃতি হয়ে ওঠে জনপ্রিয়তাবাদী(বিস্তৃত কাল্পনিক প্রগতির বা উন্নয়নকল্পের স্বপ্ন ফেরীর মাধ্যমে রাজনৈতিক সমর্থন লাভ)| ১৯৫৫ সালে রাজ কাপুর শ্রী ৪২০ চলচিত্রে গান গেয়েছিলেন – “মেরা জুতা হে জাপানি, পাতলুন ইংলিশথানি , শির মে লাল টোপি রুসি, ফির ভি দিল হে হিন্দুস্থানী”| ভারতীয় সংবিধানের মতই রাজনৈতিক সংস্কৃতিও সব দেশের সংস্কৃতির সমাহার বলা যায়|
ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই বিভিন্নতাকে আরো বেশি মাধুর্য প্রদান করেছে দুই বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক সংস্কৃতি – অর্থাৎ ক্রিয়াশীল এবং নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতির মধ্যবর্তী জায়গায় তৈরী হওয়া চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি হলো সদা পরিবর্তনশীল, দৈনন্দিন বিষয়ভিত্তিক এবং সরকার পরিচালনের চুলচেরা বিশ্লেষণের ওপর নির্ভর| এই চলমান সংস্কৃতির বিশেষত্ব হলো যে এই সংস্কৃতির প্রভাবে ক্রিয়াশীল সংস্কৃতিবানরা নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে আবার নিষ্ক্রিয় সংস্কৃতিবানরা ক্রিয়াশীল হয়ে যেতে পারে রাজনৈতিক দৈনন্দিনতার নিরিখে| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হয় গণ-মাধ্যমের পরিসরে সান্ধ্যকালীন তথাকথিত বিতর্ক-সম্প্রচারে যেখানে দৈনন্দিন বিষয়ের ভিত্তিতে কোনো রাজনৈতিক দল সঠিক হয় আবার কোনো রাজনৈতিক দল বিপদে পড়ে| কোনোদিন আবার সব রাজনৈতিক দলগুলি এত ভুলেভরা প্রতিপন্ন হয় যে লোকশক্তি বা জনগণের সমষ্টিকেই সমাজ পরিচালনার ভার দিয়ে দেওয়াই যথার্থ বলে মনে হয়| এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রিড়করা তৈরি করে অস্থিরতা, ধোঁয়াশা এবং দিকশূন্যতা| সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্যের লেখনীতে এবং নাট্যকার দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনাতে জনপ্রিয় হওয়া ‘ফ্যাতারু’ এই চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিবানদের জন্য সঠিক শব্দবন্ধ| এরা ঘোট পাকায়, জোট পাকায়, উল্টো-পাল্টা বা এলো-মেলো করে দেয় চিন্তার পরিসরকে এবং দিনের শেষে দিনটাকেই ভেস্তে দিয়ে চারিপাশকে অন্ধকারসম করে তোলে| বিগত এক বা দেড় দশকে এই দৈনন্দিন চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতির মূল আকর্ষ, পরিচয় এবং প্রবাহ|
এই তাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা জরুরী তার কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস প্রাক-স্বাধীনতা কাল থেকেই বৈপ্লবিক এবং গঠনমূলক| ক্রমাগত সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের মধ্যে দিয়ে মতাদর্শ ও সংগঠন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমার্থক হয়ে উঠেছিলো| কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিক যা সবসসময় নতুন কিছুর উন্মেষ ঘটাতো সেগুলো বাম শাসনের শক্ত ঘেরাটোপের মধ্যে হারিয়ে গেলো| তার কারণ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সবুজের অভিযান’ কবিতার মধ্যেই বর্ণিত রয়েছে - “খাঁচাখানা দুলছে মৃদু হাওয়ায়. আর তো কিছুই নড়ে না রে ওদের ঘরে, ওদের ঘরের দাওয়ায়....চলতে ওরা চায়না মাটির ছেলে, মাটির পরে চরণ ফেলে ফেলে, আছে অচল অসনখানা মেলে, যে যার আপন উচ্ছ বাঁশের মাথায়”|তাই যে বাম শাসনের হাত ধরে ১৯৭৭ সালে নকশাল আন্দোলনের অস্থির সময় পেরিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছিল ক্রিয়াশীল তা কালের নিয়মে হয়ে উঠলো নিষ্ক্রিয় বা নিস্পৃহ সংস্কৃতি| রাজনীতি থেকে মন উঠে গেলো যেন সমাজের| অন্যদিক থেকে বলা যায় এক ধরনের বশংবাদী বা দলদাস রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরী হলো যেখানে নিস্পৃহ থাকাটাই কাম্য ছিল দলের এবং দলীয় সরকারের কাছে| বাস্তু-ঘুঘুদের বাসা ভাঙার স্বপ্ন দেখিয়ে তারা সাড়ে তিন দশকে নতুন বাস্তু-ঘুঘু তৈরি করে গেলো| তাই ২০১১ সালে আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতি ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে রাজনীতিকে পরিবর্তনের আধার হিসেবে ভেবে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রায় ‘বিধির বাঁধন” ভাঙার মতোই জন-শক্তির প্রতিফলন নির্বাচনী পরিসরে বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে| বিগত এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে দোদুল্যমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে যেখানে ক্রিয়াশীল এবং নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য অতি সূক্ষ হয়ে উঠেছে| এক দশকে নতুন কিছুই স্থাপন না হলেও একই দলকে নির্বাচিত করে যাওয়ার মধ্যে স্থিতাবস্থাকামী রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছাপ দেখছেন বিশ্লেষকেরা| অর্থাৎ পুরনো দিনে (পড়ুন বাম আমলে) ফিরে যেতে বা নতুন কোনো রাজনৈতিক শক্তিকে (পড়ুন বি.জে.পি)পরীক্ষা করতে পশ্চিমবঙ্গবাসী ভীতসতন্ত্র| আর এই ভীতি তৈরী করেছে চলমান বা দৈনন্দিন রাজনৈতিক সংস্কৃতি|তাই বলা যায় সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তনকামী ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠেছে স্থিতাবস্থাকামী নিষ্ক্রিয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি|
ভারতীয় সংস্কৃতি তার্কিক বা তর্ক-প্রিয় এ কথা অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের লেখনীর দ্বারা স্বতঃসিদ্ধ| অধ্যাপক সেন তাঁর ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’ গ্রন্থে ভগবৎ গীতার তর্কের কথা তুলে ধরেছেন যেখানে শ্রীকৃষ্ণ ছলে-বলে-কৌশলে অধর্মের বিনাশ করার কর্মের মধ্যেই ধর্মকে উপলব্ধি করার কথা বলছেন এবং অর্জুন মূল্যবোধভিত্তিক দায়িত্ব-নিষ্ঠতার কর্মের মধ্যে ধর্মকে উপলব্ধি করতে চাইছেন| এই আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে ভারতবর্ষে রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক বা আলাপ-আলোচনার ইতিহাস ভারতীয় সভ্যতার সঙ্গে ওতোপ্রোতোভাবে জড়িত যেখানে মূল দ্বন্দটা হচ্ছে কৌশলভিত্তিক জনমোহিনী কর্মকাণ্ড(পড়ুন সরকারী পরিকল্পনা) বনাম মতাদর্শ-ভিত্তিক দায়িত্ব-নিষ্ঠ সমাজ-গঠনমূলক ব্যক্তির সার্বিক উন্নয়নের রূপরেখার কর্মকাণ্ড(পড়ুন দলীয় নির্বাচনী ইস্তেহারের পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি বা সামাজিক সংগঠনগুলির দাবি-সনদ)| এই দুই ধরনের কর্ম-কাণ্ডের গুণাগুণের তার্কিক আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ককে বাদ-প্রতিবাদ ধরলে সেখান থেকেই নতুন কিছুর রূপরেখা বা সম্বাদ বেরিয়ে আসতে পারে এবং এভাবেই ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিলো| কিন্তু ১৯৯০এর দশকের উদারিকরণে
র ফলে ভারতীয় সমাজ দার্শনিক সমাজ থেকে ভোগবাদী সমাজে রূপান্তরিত হয় যেখানে মতাদর্শ হয়ে ওঠে অক্ষমতার নিদর্শন| বিলাসিতা, উৎসব-মুখরতা এবং অর্থ-উপার্জন হয়ে ওঠে ক্ষমতার নিদর্শন| ক্ষমতা-অক্ষমতার দ্বন্দ্বের মধ্যে সাধারণের সক্ষমতার প্রশ্নটাই হারিয়ে যায় আর রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে ওঠে বিশ্লেষণধর্মী সংস্কৃতি যেখানে সরকার বা দলের কর্মকাণ্ডের মানে খুঁজে বের করাই যেন তর্ক-বিতর্কের মূল উদেশ্য হয়ে দাঁড়ায়| কার্ল মার্কস-এর বিখ্যাত উক্তি –“দার্শনিকেরা এতদিন সমাজকে বিশ্লেষণ করেছেন, এখন সময় সমাজ পরিবর্তনের”|ভারতীয় তথা পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আলোচনায় এই উক্তিটি বর্তমানে নতুন করে প্রাসঙ্গিকতা লাভ করেছে বলা যায়|
পশ্চিমবঙ্গের লোক-সংস্কৃতির ইতিহাসে তর্কের থেকে তরজা অনেক বেশি জনপ্রিয় ছিল| এর কারণ হলো পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে প্রথমে ব্রাহ্মণবাদ, পরে বিদেশী শিক্ষায় শিক্ষিত সমাজ সংস্কারক, তার পরে বিত্তশালী জমিদার এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক দল সমস্ত রকম জ্ঞান ও তথ্যের প্রতিভূ হয়ে আবির্ভূত হয়েছে এক একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে| তার ফলে তর্ক যা সমানে সমানে হয় সেটা হয়নি| হয়েছে তরজা অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, সমাজ সংস্কারক, জমিদার বা রাজনৈতিক দল এদের নিজেদের মধ্যে| অর্থাৎ আলাপটা হয়েছে অনুভূমিতে একটি বিশেষ শ্রেণির মধ্যে, উল্লোম্বিতভাবে শ্রেণিদের মধ্যে হয়নি| তাই সামাজিক বা রাজনৈতিক তরজা বাইরে থেকে দেখে বা শুনে উপভোগ করতো সাধারণ মানুষ| গ্রামাঞ্চলে বিশেষ করে পালাগান বা কবি-গানের লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে এই ধরনের তরজার প্রতিফলন ঘটতো| অনেক রাজনৈতিক চাপানউতোর বা সামাজিক শ্রেণি বিভাজনের সমাধান এই ধরনের পালাগানের তরজা থেকেই বেরিয়ে আসতো| বাংলা চলচ্চিত্র এন্টোনি ফিরিঙ্গি-তে এন্টোনি কবিয়ালের বিখ্যাত উক্তি – “ঐহিকে সব ভিন্ন ভিন্ন অন্তিমেতে একাঙ্গি” – বুঝিয়েই দেয় জাত পাতের ভিন্নতা বা রাজনৈতিক ভিন্নতা নশ্বর পৃথিবীর অঙ্গ এবং জীবনের শেষে সবটাই অর্থহীন হয়ে পড়ে| প্রাচীন বঙ্গ লোকসমাজে পালাগানের মধ্যে দিয়ে সামাজিক শিক্ষা প্রদান করা হতো – যেমন রামায়ণ বা মহাভারতের পালাগান| আবার পালাগানের তরজার মধ্যেও থাকতো সামাজিক বার্তা – ধর্মের কথা, সুন্দর জীবনের উপাদানের কথা ইত্যাদি| আসলে তখনকার সময় পালাগানের তরজা করার জন্য পড়াশুনা বা পুঁথি-বিদ্যা/পুঁথি-চর্চা ছিলো বাধ্যতামূলক| এন্টোনি ফিরিঙ্গি চলচ্চিত্রে এন্টোনি কবিয়ালকে যথেষ্ট বেদ, পুরাণ এবং ধর্মের চর্চা করতে দেখা গেছে কবিয়াল হিসেবে প্রসিদ্ধ হওয়ার জন্য| সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে রাজনৈতিক তরজার প্রতিফলন দেখা যেত স্লোগানে ও দেওয়াল লিখনে কিন্তু তাও প্রায় তিন চার দশক আগের কথা যখন থেকে নিম্নবর্গের ইতিহাস ও পরিচিতি চর্চা জনসমক্ষে আসতে শুরু করলো| ২০২১এর পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি রাজনৈতিক তরজা-প্রিয় কিন্তু রাজনৈতিক তরজার পরিসর এখন বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের সান্ধ্যকালীন তথাকথিত বিতর্কসভাগুলি| পশ্চিমবঙ্গবাসী আপামর ভারতবাসীর মতই এখন এক ভোগবাদী সমাজের হাতছানির সামনে দাড়িয়ে যেখানে ক্ষণিকের সুখ-বিলাসিতা অনেক বড় হয়ে ওঠে মানুষের জীবনে দীর্ঘমেয়াদী আলোচনা, মতাদর্শ বা জীবন-দর্শনের থেকে| রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও এর প্রতিফলন দেখা যায় যেখানে সাধারণ মানুষ বিষয়ের গভীরে না গিয়ে রাজনৈতিক তরজার মধ্যে থেকে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিষয় সম্পর্কে নিজেদের বিশ্বাস-অবিশ্বাস তৈরি করে নেয়|
বর্তমানে পশ্চিম দেশগুলির মতই আমাদের দেশেও এবং অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির গণমাধ্যম বিভাগ থাকে| সেখান থেকে নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি হয় প্রতি সন্ধ্যায় দলের কোন মুখপাত্র কোনো বৈদ্যুতিন চ্যানেলে গিয়ে নিজেদের দলের মত ও পথকে সমর্থনযোগ্য করে তুলবে| আবার প্রতি চ্যানেল এই দলীয় মুখপাত্রদের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ রাখে যারা এই দলীয় বিপরীতধর্মী মতকে ভারসাম্যমূলক করে এবং সঠিক করে পরিবেশন করতে চ্যানেল-এর সঞ্চালককে সাহায্য করবে| ধারণাগতভাবে বিষয়টি ভালো|বৈদ্যুতিন পরিসর একধরনের জনমত তৈরির প্রচেষ্টা বা একধরনের বৈদ্যুতিন পুরোসমাজ তৈরির প্রচেষ্টা যেখানে সরকারি প্রকল্প, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সামাজিক বিষয় বিশ্লেষণের অনুবিক্ষণের তলায় এসে স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত হয় তার সুফল এবং কুফল আলোকিত করে| কিন্তু বর্তমান সমাজের মতই বর্তমান রাজনীতির সময় নেই, আবার গভীরতাও নেই| তাই এখানে তর্ক-বিতর্ক বা আলাপ-আলোচনা হয় না, হয় তরজা – একে অন্যের বক্তব্য জোর গলায় ছাপিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা, এবং বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতটাও যখন কোনো এক পক্ষের দিকে ঝুঁকে যায় তখন প্রত্যেককে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ হয়ে নিজের বক্তব্যের সমর্থনে এত বেশি বলতে শুরু করে যে ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’ কিন্তু সারবত্তা হয় শূন্য| শেষ অব্দি চ্যানেলের সঞ্চালককে নিজ নিজ কর্পোরেট মালিকপক্ষের রাজনৈতিক ও সামাজিক মতকে সামনে রেখে অনুষ্ঠান শেষ করতে হয়| সাধারণ মানুষ দিনের শেষে দিনের বিশ্লেষণে সব রাজনীতিকে সমান ভাবা ছাড়া আর কোনো পথ পায় না| কিন্তু সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কোনো এক রাজনীতিকে আপন করে নিতেই হবে সরকার ও সমাজ পরিচালনের জন্য| তাই ‘খারাপের’ মধ্যে তুলনামূলক ‘ভালো’-কে জেতাতে হয় ভারাক্রান্ত মন নিয়েও|
২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন পশ্চিমবঙ্গবাসীর রাজনৈতিক-তরজাপ্রিয়তা সংস্কৃতির চরমতম নিদর্শন| বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার থেকে নির্বাচনের দিনগুলি, নির্বাচনের দিনগুলির মধ্যবর্তী দিনগুলি থেকে নির্বাচনী ফলাফল বেরোনোর পরবর্তী সময়ে, রাজনৈতিক তরজার উচ্চলয় সমস্ত গণগমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে| এমনকি নির্বাচনের আটটি পর্যায়ের মধ্যে প্রচার অভিযান নিয়ে, শিতলকুচিতে গুলি চালানো নিয়ে, রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে, করোনা সময়ের বিধি-নিষেধ মান্য-অমান্য নিয়ে, করোনা টিকা নিয়ে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে শুধু আলোচনা হয়নি, হয়েছে তরজা, এবং মানুষকে ভাবায়নি, মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে একটি নির্দিষ্ট আবেগের দিকে – বাঙালি আবেগ বনাম বহিরাগত আবেগের মধ্যে| এর ফলে আবেগহীন রাজনীতি অর্থাৎ মতাদর্শগত রাজনীতি নির্বাচনে দাগ কাটতে পারেনি| বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস কোনো আসন পায়নি পশ্চিমবঙ্গের এবারের নির্বাচনে, যদিও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পেছনে এই দুই দলেরই সব থেকে বেশি ভূমিকা লক্ষ করা গেছিলো| রাজনৈতিক তর্কে এরা রয়েছে, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে এরা রয়েছে, সামাজিক পরিসরে তো রেড ভলান্টিয়ার্সদের নাম না করলে পশ্চিমবঙ্গের করোনাকালের ইতিহাস রচনাটাই অসমাপ্ত থেকে যাবে কিন্তু রাজনৈতিক তরজাতে এরা জায়গা করে নিতে পারেনি কারণ রাজনৈতিক তরজা জনপ্রিয়দের নিয়ে হয়, জনসমক্ষে যা ঘটে বা যারা ঘটায় তাদের নিয়ে হয়, অলক্ষ্যে যারা থাকে, বা রাজনৈতিক ভাবে যারা প্রান্তিক তাদের নিয়ে হয় না কারণ তাতে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের টি.আর.পি বাড়েনা| সাধারণ মানুষ পশ্চিমবঙ্গে আড্ডা-প্রিয়| করোনা সময়ে তো আড্ডা প্রায় উঠেই গেছে, সব আড্ডাই ভার্চুয়াল বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমে| তাই রাস্তার আড্ডার র্রাজনৈতিক তর্ক আজ পর্যবসিত হয়েছে বৈদ্যুতিন আড্ডার তরজায়| যে ধারা শুরু হয়েছিল ১৯৯০এর দশকে প্রণয় রায়ের হাত ধরে নির্বাচনী সমীক্ষার মাধ্যমে, আজ তা হয়ে উঠেছে রোজকার রাজনৈতিক সমীক্ষা| প্রতিদিন সমস্ত রাজনীতির ধারাকে যেন পরীক্ষায় বসতে হয়| যেন গণমাধ্যমের রাজনৈতিক তরজায় জয়লাভ বাস্তব রাজনৈতিক পরিসরের জয়লাভকে অনেকটাই সুনিশ্চিত করে দেয়| এর একটা বড় কারণ মহিলাদের রাজনৈতিক ক্রীড়নক হিসেবে গুরুত্ব বৃদ্ধি| আগেকার দিনে রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব চর্চা হতো পৌর-সমাজে রাজনৈতিক দলগুলির সভা সমাবেশে বা দেয়াল লিখন বা স্লোগানে-প্রচারে| সেখানে পুরুষদের আধিক্য ছিল বেশি এবং তারাই বাড়ির মহিলাদের কাছে সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে ‘সঞ্জয়’ হয়ে উঠত কারণ বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমের এতো চ্যানেলের প্রাদুর্ভাব ঘটেনি| কিন্তু আজকে এই সান্ধ্যকালীন তর্কের দর্শক অনেকটাই মহিলারা এবং মহিলারা ভোটদান করেছেন অনেক বেশি সাম্প্রতিক সময়ে| তাই বলা যায় রাজনৈতিক তরজা রাজনীতির সর্বসাধারণীকরণ ঘটিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে এবং রাজনীতিকে করেছে জনপ্রিয়| রাজনৈতিক তরজার জনপ্রিয় হওয়ার আরেকটি কারণ হলো সাধারণ মানুষের মনে অনেক সময় সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা থাকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে তিরস্কার করার| রাজনৈতিক তরজা মানুষের মনের সেই সুপ্ত তাড়িত বাসনাকে পূর্ণ করে|
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতি হঠকারিতার সংস্কৃতি, মুহূর্তের আবেগের সংস্কৃতি এবং দৈনন্দিনতার সংস্কৃতি| তার কারণ এই সংস্কৃতির আধার হলো রাজনৈতিক তরজা| রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক নতুন কিছুর রূপরেখাকে সামনে আনে| তাই এক সময়ে বলা হতো ‘আজ বাংলা যা ভাববে ভবিষ্যতে ভাববে তা ভারতবর্ষ’| কিন্তু আজ বিশ্ব-বাংলা ফলক রাজ্যজুড়ে ছেয়ে গেলেও নতুন ধারণার বা নতুন কর্মসূচির আমদানি ঘটছে না যা ভারতবর্ষের কাছে মডেল স্বরূপ হয়ে উঠবে| কারণ সব রাজনীতিটাই যেন খুব চেনা ক্ষমতার রাজনীতি| আলাদা কোনো পরিবর্তনের রাজনীতি বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না| এর অনেকটা দায় রাজনৈতিক তরজার যারা রাজনীতিকে তো মানুষের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে কিন্তু রাজনীতি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরী করছে মানুষের মনে| তাই গণমাধ্যমগুলির উচিৎ রাজনৈতিক তরজা বন্ধ করা| এবং রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক ও আলাপ আলোচন শুরু করা| যেখানে রাজনৈতিক দলগুলির কর্মকাণ্ড এবং সরকারের কর্মসূচি নিয়ে সপ্তাহান্তে একদিন বসুক বিশ্লেষকেরা, করুক নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ এবং প্রতিফলন ঘটাক গঠনমূলক বিরোধিতা এবং গঠনমূলক সমর্থনে নতুন কর্মকান্ডের রূপরেখা দিয়ে| আরেকদিন সপ্তাহান্তে বসুক রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিরা যারা সেই বিশেষ মতামতগুলির থেকে নির্যাস নিয়ে তাদের দলীয় নেতৃত্বের কাছে সমাজের বার্তা পৌঁছে দিক|
সমকালীন পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সবাই যেন ভগবৎ গীতার শ্রীকৃষ্ণ| যেভাবেই হোক যুদ্ধে জয়লাভ দরকার, কারণ যুদ্ধে না জিতলে ধর্ম স্থাপনা বা মানুষের জন্য কাজ করা যাবে না| ভগবতগীতার অর্জুনের বড়োই অভাব যেখানে দ্বায়িত্ব ও সাম্য নিয়ে ভাবনা ধর্মের(ন্যায়ের) প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধে পরাজিত হয়েও কাজ করবে|আজ যারা ‘শূন্য’ তারাই বোধহয় পারেন এই নতুন দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ‘রাম’-কে বনবাসে পাঠিয়ে, ‘সীতা’-কে বিশ্রাম দিয়ে ‘ধরো হাল শক্ত হাতের’ বাণীতে উদ্দীপ্ত হয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে রাজনৈতিক তরজার জায়গায় রাজনৈতিক তর্ক ফিরিয়ে আনতে এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাজ-অর্থনীতি পুনর্নবীকরণের দিকনির্দেশ করতে| এই বিকল্প ভাবনা যত শীঘ্র সামনে আসবে ততোই রাজনৈতিক সংস্কৃতি হয়ে উঠবে মতাদর্শ ভিত্তিক এবং সমাজিক পরিসরে গড়ে উঠবে| তাই কোনো ভাণ না করে উপসংহারে বলি, আজ যারা রাজনৈতিকভাবে শূন্য তাদেরই দ্বায়িত্ব বেশি, তাদেরই কাজ করতে হবে বেশী কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দিতে হবে – গণমাধ্যম-কেন্দ্রিক আবেগঘন চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে করে তুলতে হবে মানবিক, ক্রিয়াশীল এবং জনকেন্দ্রিক| তাই ‘চরৈবেতি, চরৈবেতি’|
বি:দ্র: - লেখক তার ২০০১-২০০৪ সালের প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতক পর্যায়ের ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি সম্পর্কে সম্যক বাস্তবিক ধারণা লাভ করেন| সেই সময়ের সমস্ত অগ্রজ এবং সমসাময়িকদের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ এই লেখা| তাই এই লেখায় কোনো গ্রন্থপঞ্জি নেই| সবটাই অভিজ্ঞতা থেকে লেখা|
*লেখক কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক|
Comments